এ রাজ্যে সরকারি আপিসের বাবুরা এ সব কখনও ভাবেননি। ছাতা বগলে কোনও মতে পান চিবোতে চিবোতে দুপুরে অফিসে ঢুকে বিকেল গড়াতে না-গড়াতেই বাড়িমুখো ধাঁ। সরকারি কর্মসংস্কৃতি বলতে এটাই ছিল দস্তুর। এই ভাতঘুমের দেশে
এ বার ঘাম ঝরানোর মেশিন বসাচ্ছে রাজ্য সরকার।
তৃণমূল সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরতেই বদল আসতে চলেছে নবান্ন’র জীবনযাত্রায়। রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতার কেন্দ্রে ‘মাল্টিজিম’ বসানোর সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা। কার মস্তিষ্কপ্রসূত এই পরিকল্পনা, তা অবশ্যই বলা বাহুল্য। খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজে হাঁটা-অন্ত-প্রাণ। বাড়িতে ‘ট্রেডমিল’ বা ‘ক্রসট্রেনার’ বসিয়েছেন। পাহাড়ে-জঙ্গলে-বিলেতে যেখানে যান, ফাঁক পেলেই কয়েক কিলোমিটার হনহনিয়ে হেঁটে নেন। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে সঙ্গীদের দশা হয় ল্যাজেগোবরে। এমনকী, নবান্নে তাঁর ১৪ তলার সুদৃশ্য কক্ষেও কাজের ফাঁকে ঘুরঘুর করে হাঁটতে থাকেন মমতা। আর বিভিন্ন বক্তৃতায় সরকারি কর্মী তথা আমলাদের প্রায়ই বলেন, ‘‘আপনারা হাঁটুন। ব্যায়াম করুন। ছিপছিপে থাকুন। সুস্থ থাকবেন।’’
মুখ্যমন্ত্রীর এই ভাবনা কার্যকর করতেই নবান্নে ফাইল নড়তে শুরু করেছে। পূর্ত দফতর ‘মাল্টিজিম’ সংক্রান্ত পরিকল্পনাটি তৈরি করেছে। তাতে সিলমোহর পড়েছে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রূপরেখাটি এখন মুখ্যমন্ত্রীর বিবেচনাধীন।
ইদানীং কর্পোরেট ধাঁচের বেশির ভাগ অফিসেই ঘড়ি অন্য রকম। সকালে নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে ঢোকা, সময়সীমা মেনে কাজ শেষ করা, কোনও কোনও দিন খানিকটা উটকো সময়ে জরুরি মিটিংয়ে বসা...। সেখানে বহু অফিসেই জিমের ব্যবস্থা আছে। তারই ছোঁয়া এ বার সরকারি অফিসেও। সরকারি আমলা, বিশেষত বিভিন্ন দফতরের শীর্ষস্তরের কর্তাদের অনেককেই এখন দীর্ঘ ক্ষণ অফিসে থাকতে হচ্ছে। এই বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বসতে
চলেছে মাল্টিজিম।
এর মধ্যেই সচিবমহলে বিষয়টি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ রাজ্যের পূর্বতন মুখ্যসচিবের সাতসকালে হাঁটা ও সাঁতারের অভ্যাস অনেকের কাছেই সুবিদিত ছিল। তাঁর আর এক পূর্বসূরি টেনিস খেলতেন। রাজ্যের আইপিএস-দের মধ্যে কেউ সকালে গল্ফ খেলেন, কেউ ‘হর্সরাইড’ করে চাঙ্গা থাকেন। সকালে লেকে, ময়দানে বা অন্যত্র হাঁটার অভ্যাসও অনেক আমলারই রয়েছে। তাঁদেরই একজন বলছিলেন, ‘‘সকালে ঘাম না-ঝরালে সারা দিন মনটা খুঁতখুঁত করত। অফিসের ভিতরেই এমন সুযোগ মিললে আর আক্ষেপ থাকবে না। বরং মাঝেমধ্যে আগেভাগে অফিসে এসে শরীরচর্চা সেরে কাজে মন দেওয়া যাবে।’’
দিল্লির রাস্তায় আসন পেতে নরেন্দ্র মোদী যোগ-প্রচারে নেমেছিলেন। তবে তার রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে বিতর্ক ছিল। সেই সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নির্বিচারে যোগ অনুশীলনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। মমতা সরকারের জিম-প্রীতির সঙ্গেও উপযুক্ত ফিটনেস বিশারদের উপস্থিতি আবশ্যক বলে অনেক সরকারি কর্তা মনে করছেন। তাঁদের আশঙ্কা, তা না-হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে কর্মীদের কাজের লম্বা নির্ঘণ্টের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘জিম’ করার সুবিধে যে সত্যিই জরুরি এ নিয়ে দ্বিমত নেই বেশির ভাগ কর্পোরট কর্তার। তত্ত্বাবধানের জন্য উপযুক্ত ফিটনেস বিশারদ থাকলে, এই পদক্ষেপ ইতিবাচক হিসেবেই দেখবেন সফ্টব্যাঙ্ক সংস্থার পাবলিক অ্যাফেয়ার্স-সংক্রান্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট পরমা রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘বিদেশে বা দেশের অনেক কর্পোরেট অফিসেই লোকে অফিসেই ‘ওয়র্ক আউট’ করে স্নান সেরে কাজ শুরু করেন। ভারতীয়েরা অনেকে আবার বিকেলে কাজ সেরে গা ঘামিয়ে বাড়ি ফিরতে ভালবাসেন। জিম ব্যবহারের জন্য
সময়টা সবার সুবিধেমাফিক হওয়া চাই।’’ কলকাতায় একটি বহুজাতিক সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের কর্তা অরুণাভ মৈত্রও বলছেন, ‘‘এখন ব্যস্ত পেশাদারদের অনেকের জীবনেই জিমে যাওয়াটা রোজনামচার অঙ্গ। অফিসে তেমন সুযোগ পেলে কর্মীরা খুশিই হবেন।’’ বিপণন বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, রাজ্য সরকারের ‘কর্মীবন্ধু’ ব্র্যান্ড-নির্মাণে এই জিম-নির্মাণ অবশ্যই সহায়ক হবে। বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ রাম রায় সেটাই মনে করেন। তবে তাঁর কথায়, ‘‘এটা দেখতে হবে, বিষয়টা যেন নেহাতই লোকদেখানো না-হয়ে যায়।’’
মহাকরণ থেকে নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের ঠাঁই বদলের পরে সরকারি অফিসের চেহারা অনেকটাই ঝকঝকে হয়েছে। পানের ছোপ-লাগা নোংরা দেওয়াল দেখা যায় না। অফিসের অলিন্দে ইউনিয়নের মিটিং-মিছিলও বন্ধ। আমলাদের অনেকের মতে, জিমের সুবিধা মিললে অফিসের ভিতরে কর্মীরা খানিকটা বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করবেন। সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটে বিপুল জনাদেশ পেয়ে মমতার দল ফের নবান্নে ফিরলেও সরকারি কর্মীদের মধ্যে বকেয়া ডিএ নিয়ে এখনও খানিকটা ক্ষত রয়েছে। শাসক দলের অনুগত ইউনিয়নের এক নেতা সে-কথা মনে করিয়ে দিয়েও হাসছেন, ‘‘যাক! সরকার যে কর্মীদের ভালমন্দের কথা ভাবেন, এটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে!’’