মাখড়া-ক্ষতে প্রলেপ দিতে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা নবান্নের

ধর্ষণ থেকে খুন, বিষ মদে মৃত্যু থেকে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি অতীতে বিপাকে পড়লেই যে রাস্তায় হেঁটেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাখড়া-কাণ্ডেও হাঁটলেন সেই রাস্তাতেই। বীরভূমের ওই গ্রামে নিহত তিন জনের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা শনিবার ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। আইনগত ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ায় কোনও বাধা না-থাকলেও ঘটনা হল, গত সাড়ে তিন বছরে রাজ্য জুড়ে একাধিক হানাহানির ঘটনায় নিহতদের পরিজনদের কোনও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়নি। ক’দিন আগেই মালদহের ইংরেজবাজারে একটি ঘটনায় চার জন খুন হয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৬
Share:

আটকে গেলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। শনিবার চৌমণ্ডলপুরের কাছে বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।

ধর্ষণ থেকে খুন, বিষ মদে মৃত্যু থেকে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি অতীতে বিপাকে পড়লেই যে রাস্তায় হেঁটেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাখড়া-কাণ্ডেও হাঁটলেন সেই রাস্তাতেই। বীরভূমের ওই গ্রামে নিহত তিন জনের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা শনিবার ঘোষণা করল রাজ্য সরকার।

Advertisement

আইনগত ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ায় কোনও বাধা না-থাকলেও ঘটনা হল, গত সাড়ে তিন বছরে রাজ্য জুড়ে একাধিক হানাহানির ঘটনায় নিহতদের পরিজনদের কোনও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়নি। ক’দিন আগেই মালদহের ইংরেজবাজারে একটি ঘটনায় চার জন খুন হয়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে ছুটে যেতে হয়েছে স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের কোনও ঘোষণা এখনও হয়নি।

মাখড়ায় গোলমালের সূত্রপাত বহিরাগত এনে তৃণমূলের গ্রাম দখলের চেষ্টা থেকে। তৃণমূল বাহিনীর আক্রমণে প্রথমে বিজেপি সমর্থক পরিবারের এক কিশোরের প্রাণ যায়। তার পর বিজেপি সমর্থকদের পাল্টা আক্রমণে মারা যান দুই তৃণমূল সমর্থক। (যদিও পরে এই দু’জনের এক জনকে তাদের সমর্থক বলে দাবি করে বিজেপি।) নবান্ন সূত্রে খবর, মাখড়া-দখলের চেষ্টা যে শাসক দলের প্ররোচনাতেই, পুলিশের রিপোর্টেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুলিশ হাজির থাকা সত্ত্বেও তাদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েই যে গ্রামে ঢুকেছিল তৃণমূলের বাইক-বাহিনী, জেলা গোয়েন্দাদের রিপোর্টে কোনও আড়াল না-রেখেই তা জানানো হয়েছে। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দিন তৌসিফ শেখ নামে মাখড়ার নিতান্তই আটপৌরে এক কিশোরের মৃত্যুর পরে শুধু ওই গ্রামটিই নয়, আশপাশের বহু গ্রামের সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছে বিজেপি। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “এই অবস্থায়, ক্ষতিপূরণ দিয়েই মাখড়ার মন পেতে চাইছে রাজ্য সরকার।”

Advertisement

তৌসিফের পরিবার সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, তারা শেষ পর্যন্ত মমতার সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণ না-ও নিতে পারে। তবে বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, “ওরা গরিব মানুষ। তাই যদি ক্ষতিপূরণ নেয়, তা হলে আমরা আপত্তি করব না।”

এই ক্ষতিপূরণ যে আসলে শাসক দলের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা, সেটা বলছে বিরোধীরাও। তাদের বক্তব্য, রাজ্য জুড়ে দ্রুত জমি হারাচ্ছে তৃণমূল। পাড়ুই লাগোয়া গ্রামগুলিতে ক্রমেই আধিপত্য বাড়ছে বিজেপির। মানুষের মন ফেরাতে তাই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার সহজ রাস্তা হিসেবে ক্ষতিপূরণকেই বেছে নিয়েছে রাজ্য সরকার। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন স্পষ্টই বলছেন, “এই সরকার বরাবর টাকা দিয়ে মন জয়ের সহজ রাস্তায় হাঁটতে চেয়েছে। মাখড়ায় তাণ্ডব চালানোর আট দিন পরে সেই চেনা রাস্তাতেই হাঁটল তারা।” তাঁর দাবি, রাজ্য জুড়ে, বিশেষ করে বীরভূমে বিজেপি-র প্রসার ঘটছে দ্রুত। আতঙ্কিত হয়ে তাই ক্ষতিপূরণ দিয়ে মাখড়ায় তাদের হারানো জমি ফিরে পেতে চাইছে তৃণমূল-সরকার।

কিন্তু ক্ষতিপূরণের প্রলেপে ক্ষত সারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পরে আদালতের নির্দেশে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু তাতে তাদের হারানো ভোট ব্যাঙ্ক ফিরে আসেনি।

তবে মাখড়ায় নিহত তৃণমূল সমর্থকের কথা ভেবেই এই ক্ষতিপূরণের আয়োজন, এমন জল্পনাও রয়েছে। শুক্রবারই বোলপুর সফরে গিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। মাখড়া-কাণ্ডে যাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে, দলের ইলামবাজারের ব্লক তৃণমূল সভাপতি সেই জাফারুল ইসলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তৃণমূল সূত্রে খবর, মুকুলকে তিনি জানান, দলের নির্দেশেই তাঁরা কাজ করেছেন। এক জেলা নেতার কথায়, “মাখড়ায় নিহত দলীয় কর্মী সোলেমান শেখের স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন জাফারুল। মুকুলবাবুকে তিনি বলেন, এঁদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কিছু করুন।” তদন্তে নেমে পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে, তাদের মধ্যে ১৪ জনই দলীয় কর্মী-সমর্থক। মুকুলবাবুকে দলের জেলা নেতাদের প্রশ্ন ছিল, ‘এর পরেও কোন মুখে এলাকায় রাজনীতি করব?’ নিশ্চুপ মুকুল কোনও জবাব দিতে পারেননি। তার পরেই এই ক্ষতিপূরণের ঘোষণা।

১৪৪ ধারা জারি করে মাখড়ার ঘটনা আটকাতে না-পারলেও গত ক’দিনের মতো এ দিনও প্রদেশ কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলকে ওই গ্রামে যাওয়া থেকে আটকেছে পুলিশ। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এ দিন মাখড়া যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। পথেই বসে পড়েন অধীরবাবু। পরে তিনি বলেন, “এখানকার সাধারণ মানুষ চরম দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন। তাঁরা উপার্জনের জন্য বাইরে যেতে পারছেন না। এখানকার মানুষকে ঘাম ফেলে রোজগার করতে হয়। কিন্তু ১৪৪ ধারা জারি বলে তাঁরা ন্যূনতম পরিষেবাটুকুও পাচ্ছেন না।” একই সঙ্গে তাঁর হুঁশিয়ারি, “৭ দিন সময় দিচ্ছি, তার মধ্যে ১৪৪ ধারা না-তুললে বাংলার সমস্ত কংগ্রেস কর্মীকে এনে এলাকার মানুষের সঙ্গে এখানে সমাবেশ করব। মানুষই পুলিশের উপর ১৪৪ ধারা জারি করবে।”

নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পরে, বাম জমানার যখন শেষের শুরু, তখন বামফ্রন্টের মুখ্য সচেতক মহম্মদ মসীহ বিধানসভায় আক্ষেপ করেছিলেন, “আমরা সরকারে আছি ক্ষমতায় নেই।” বিরোধীদের কটাক্ষ, সে কথা স্মরণ করতে পারে রাজ্য সরকার। নিদেনপক্ষে বীরভূমের পরিপ্রেক্ষিতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন