আদালতের পথে ধৃতেরা।
মুম্বই পাড়ি দিয়েছিল ছেলে। উদ্দেশ্য একটাই— মাফিয়া ডন হবে সে। সেই মতো ধারাভিতে পা রেখে শহরের কুখ্যাত সব দুষ্কৃতীদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তৈরি করে গ্যাং। ক্রমে ‘সুরিয়া’ হয়ে ওঠে মুম্বইয়ের কুখ্যাত ‘গ্যাংস্টার’।
ছবির নাম ‘বস’। ‘সুরিয়া’র চরিত্রে অভিনেতা জিৎ।
সিনেমায় যেমন হয়— তেমনটাই যদি করা যায়! ভাবনাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা ছয় কিশোরের। তারপর তৈরি হল গ্যাং। নাম রাখা হল ‘সুরিয়া এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট’, সিনেমার আদলেই। নিজেদের আসল নাম বললে যদি ধরা পড়ে যায়? তাই ঠিক হল সাংকেতিক নাম। লিডারের নাম হল সূর্য। বাকিরা ব্ল্যাক, ড্যানি, কেকে, হিরা, দ্বীপ।
ফিল্মে মুম্বইয়ের বড় বড় ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে তোলা আদায় করত সুরিয়া। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ঘটল না। এলাকার পয়সাওয়ালা লোকেদের বেছে নিল ৬ কিশোর। তার পর ফোন করে, কখনও বা এসএমএস করে টাকা আদায়ের চেষ্টা। কারও কাছে ৫ লাখ তো কারও কাছে ৮ লাখ টাকার দাবি।
ফিল্মি কায়দায় দিব্যি চলছিল গ্যাং। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। শনিবার ছয় পড়ুয়াকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধৃতেরা নাকাশিপাড়ার ‘ড্যানি’ ও ‘সূর্য’, দেবগ্রামের ‘হিরা’, কালীগঞ্জের ‘ব্ল্যাক’, দেবগ্রামের ‘কেকে’ ও ‘দীপ’। ধৃতদের রবিবার কৃষ্ণনগরে এসিজেএম আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের হোমে রাখার নির্দেশ দেন। আজ, সোমবার তাঁদের জুভেনাইল আদালতে হাজির করানো হবে।
ঠিক কী ঘটেছিল?
সম্প্রতি দেবগ্রামের বিভিন্ন বাসিন্দাদের কাছে টাকা চেয়ে উড়ো ফোন আসছিল। এমনই এক জন গয়নার দোকানের মালিক গৌরব সাহা। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘২ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত, একটা মোবাইল নম্বর থেকে আমাকে নানা রকম হুমকি এসএমএস পাঠানো হচ্ছিল। ৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম পরিচিত কেউ ঠাট্টা-তামাসা করছে। কিন্তু পরে জানতে পারি, আমাদের পাড়ার এক শিক্ষককেও একই ভাবে ফোন এসএমএস করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’’ এর পর জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি দেবগ্রাম পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে বিষয়টি লিখিত ভাবে জানান।
হুমকি দেওয়া এসএমএস।
ফোন পেয়েছিলেন দেবগ্রাম স্টেশন পাড়ার বাসিন্দা দেবগ্রামের বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের ইংরেজি শিক্ষক আব্দুর রহিম মোল্লাও। বললেন, “১২ জুলাই বিকেলে আমি স্কুলে ছিলাম। হঠাৎই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে এসএমএস ফলো করতে বলে। এর পরেই দেখি ৫ লক্ষ টাকা তোলা চাওয়া হয়েছে এসএমএসে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘হুমকি দেওয়া হয়, টাকা তাদের বলে দেওয়া জায়গায় না রাখলে আমার ছেলেকে অপহরণ করা হবে। ফলে আমরা আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম।’’
এর পরই বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ। শনিবার রাতে গ্রেফতার হয় ৬ পড়ুয়া। ধৃতরা একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তাদের মধ্যে ৫ জন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। এক জন পড়াশোনা করে ভোকেশনাল কোর্সে। এ দিন জেরার মুখে ধৃতেরা জানায়, জিৎ অভিনীত ‘বস’ দেখেই তারা ঠিক করে, এমন একটা গ্যাং বানালে কেমন হয়। ‘রোজ গ্যাং’ নামে আরও একটি নাম দিয়েছিল তারা। কখনও ‘সুরিয়া এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট’ কখনও বা রোজ গ্যাং, এক-এক সময়, এক-এক নামে তারা লোকজনকে ভয় দেখাতো। কখনও দাবি বড় অঙ্কের টাকা তো কখনও আইফোন। সঙ্গে হুমকি, কথা না শুনলেই অপহরণ কিংবা খুন করা হবে।
পুলিশ সূত্রের খবর, ‘ড্যানি’ এবং ‘সূর্য’ ছিল গ্যাং লিডার। ধৃতদের মধ্যে কেউ পুলিশের এএসআইয়ের ছেলে, কেউ বা ভুষিমালের ব্যবসায়ীর ছেলে, কেউ আবার আইনজীবীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তারা পুলিশকে জানিয়েছে, দামি মোটরবাইক, আইফোনের শখ মেটাতেই এই পরিকল্পনা করে তারা। সেই মতো সিনেমার চিত্রনাট্যের কায়দায় ‘সুরিয়া এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট’ খুলে বসে। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের মধ্যে ‘ব্ল্যাক’ নিজের বাবার কাছ থেকেও টাকা আদায়ের ছক কষেছিল। সে ক্ষেত্রে বন্ধুরাই অপহরণ করতো ব্ল্যাককে, আর তার পর মুক্তিপণ আদায়। ব্ল্যাককে অপহরণের সেই ব্লু প্রিন্ট এখন পুলিশ হাতে। তা ছাড়াও দু’টি মোবাইল ও একটি সিমকার্ড উদ্ধার হয়েছে। কাগজপত্র ছাড়াই ওই সব সিম কার্ড সংগ্রহ করা হয়েছিল।
ব্ল্যাককে অপহরণের সেই ব্লু প্রিন্ট।
স্থানীয়দের দাবি, উড়ো ফোন, এসএমএস, চিঠিতে গত আড়াই মাসে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল দেবগ্রামে। ছয় খুদে দুষ্কৃতী ধরা পড়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে এলাকায়। তিন জনকে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি পুলিশের নজরে এলেও, আরও অনেকের কাছেই ফোন গিয়েছিল বলে সন্দেহ পুলিশের। তবে এক বারও তারা সফল হয়েছিল কি না, এখনও সেটা পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়। নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “আমরা অভিযোগ পাওয়ার পরে তদন্ত নেমে ছ’জনকে গ্রেফতার করেছি। এই কিশোর বয়সে ওরা কেন এই ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়ল, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
গোটা ঘটনাটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন স্থানীয় শিক্ষক আব্দুর রহিম মোল্লা। বললেন, ‘‘যে ৬ জন স্কুল পড়ুয়া এই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েক জন মাঝেমধ্যে আমার কাছে পড়তে আসত। ওরা যে এই কাজ করতে পারে, ভাবতে পারছি না।’’ ধৃতদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, “লোক মুখে বিষয়টা শুনেছি। সোমবার পরিচালন সমিতিতে আলোচনা করে ওদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে স্কুল। তবে আমি চাই, নিজেদের ভুল শুধরে সুস্থ জীবনে ফিরে আসুক ওরা।” তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ ধরনের কাজে নতুন হলেও অনেক দিন ধরেই নানা ধরনের নেশায় হাত পাকিয়েছিল ওই ছ’জন।
‘‘কিন্তু তা বলে খুনের হুমকি দিয়ে টাকা তোলা!’’— এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না ‘সূর্য’দের বন্ধুরা।