বিষাদ বইছে জারিগান 

জারিগানের রচনাকার সিরাজুল ইসলামের মতে, “অবিভক্ত বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলে ‘মর্সিয়া’ জারির উদ্ভব, যা পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে সংলগ্ন নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে। নদিয়ার লোকসংস্কৃতির ধারাটি বরাবরই সমৃদ্ধ। বছরের পর বছর ধরে তার বিস্তার।”

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৩২
Share:

চলছে জারিগান। সোমবার ধুবুলিয়ার সোনডাঙায়। —নিজস্ব চিত্র

বুক চাপড়ে হাহাকার করে কাঁদছিলেন ওঁরা। পরনে কালো পাজামা-পাঞ্জাবি। কালো কাপড়ে মাথা ঢাকা। ওঁদের ঘিরে কয়েকশো নারী-পুরুষ। অর্ধ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে বুকে চাপড় মেরে যেন ভিতর থেকে তুলে আনছিলেন কথাগুলো—“কোথা আছো মা ফতেমা এসে একবার দেখো না, তোমার দুলাল ধূলায় পড়ে আর তো প্রাণে সয় না।”

Advertisement

খালি গলায় মূল গায়েন এক বার গাওয়ার পরেই ধরতাই নিচ্ছিল সহ গায়কের দল। জারিগানের একটানা করুণ সুরে ভেসে যাচ্ছিল প্রান্তর। থমথমে বিশাল মানিকতলা ময়দান।

মহরমের শোকে প্রতি বছর এ ভাবেই ভাসে নদিয়ার ধুবুলিয়া, শোনডাঙা, বামুনপুকুর, মোল্লাপাড়া, হাতিপোতা, মহিশুরার মসজিদ থেকে মাজার। শোকের পরব মহরম স্মরণে কবে থেকে নদিয়ার মানুষ জারিগান গাইছেন, তার স্পষ্ট হদিস মেলে না। জারিগানের রচনাকার সিরাজুল ইসলামের মতে, “অবিভক্ত বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলে ‘মর্সিয়া’ জারির উদ্ভব, যা পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে সংলগ্ন নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে। নদিয়ার লোকসংস্কৃতির ধারাটি বরাবরই সমৃদ্ধ। বছরের পর বছর ধরে তার বিস্তার।”

Advertisement

ফারসি ভাষায় ‘জারি’ কথার অর্থ শোক, বিলাপ বা কান্না। কোনও অভিধানে বলা হয়েছে ‘কারবালার ঘটনা নিয়ে বাংলার গ্রামীণ শোকগাথা’ হল জারি। মহরমের ইতিহাস প্রায় চোদ্দোশো বছর আগের। কারবালার মাঠে ফুরাত নদীর তীরে মহরম মাসের দশ তারিখে এজিদের সেনাবাহিনীর হাতে হজরত মহম্মদের দৌহিত্র হোসেনের সপরিবার নৃশংস মৃত্যু হয়। তার আগে এজিদ কৌশলে বিষ প্রয়োগ করে হজরত মহম্মদের অপর দৌহিত্র ইমাম হাসানের উপর। সেই কারবালার মাঠেরই কাহিনি ছোট ছোট গানে তুলে ধরা হয় জারিতে। বদলে যাওয়া সময়ে জারিতে আগ্রহ কমছে নব্যপ্রজন্মের। একদা নদিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় জারিগান নিয়ে বর্তমানে তুমুল উন্মাদনা দেখা যায় মূলত ধুবুলিয়া, শোনডাঙা প্রভৃতি এলাকায়। হয় প্রতিযোগিতা। দু’দিন ধরে শোনডাঙার জুবিলি ক্লাবের আয়োজনে জারিগান প্রতিযোগিতায় একুশটি জারির দল অংশ নিয়েছিল। কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকা মানুষেরাই এ সময়ে বদলে যান জারিগান-শিল্পীতে। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর চলে অনুশীলন। নতুন গান নতুন ভাবে গাওয়ার প্রস্তুতিতে বুঁদ হয়ে থাকেন রহমত শেখ, আবু তাহের, মুকশেদরা।

ছাত্রজীবনে নিজেই জারি গাইতেন। এখন শুধু কথা লেখেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “কারুণ্য মহরমের একমাত্র সুর। চেনা কথা, চেনা সুরে যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়া উপস্থাপনা হয়তো এই প্রজন্মের ভাল লাগছে না। আবার, শ্রোতারা পছন্দ করছেন না বলে যদি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জারি গাইতে যান, তা হলে জারিগান চরিত্র হারাবে।’’ সুতরাং, তাঁর মতে, কথায় মারপ্যাঁচে নতুন করে উপস্থাপনা ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই জারি গায়কদের।

জারিগানে ‘শাহেরবানু’ বা ‘সাকিনাবানু’র কান্নাকে প্রান্তিক মানুষেরা ব্যক্তিগত কান্না হিসাবে দেখেন। কারবালার মাঠে একরত্তি পিপাসার্ত শিশুকে এজিদের সৈন্যরা বিষাক্ত তীরে হত্যা করেছিল। সে শোকের সঙ্গে ধুবুলিয়ার দিনমজুরের দুর্ঘটনায় মৃত ছেলের শোক এক হয়ে যায়। মিলেমিশে বয়ে চলে জারি গান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন