মরেও সাঁতার কাটত গোয়ালিনি

চারদিকে অন্ধকার। জেঠুর চেয়ারের সামনে হ্যারিকেনের শিখা বাতাসে দুলছে। লম্বা বারান্দায় পাটি বিছিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি আমরা। বারান্দায় মেলে দেওয়া ঠাকুমার সরু পাড়ের সাদা শাড়ি বাতাসে উড়ছে। হ্যারিকেনের আলোয় সেই অদ্ভুত ছায়া সরে সরে যাচ্ছে দেওয়ালের গায়ে।

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৭ ০০:০৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

প্রতি বছর পুজোর লেখা শেষ করে বড় জেঠু সপরিবার চলে আসতেন দেশের বাড়ি, খোশবাসপুরে। বড় জেঠু মানে সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। জেঠু আসা মানেই রণগ্রামে দ্বারকার পাড়ে পিকনিক, হইহই করে কেটে যেত কয়েকটা দিন। বাড়ি ফিরে বসত গান ও গল্পের মজলিস। এমনই এক সন্ধ্যায় মুষলধারে বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নিমগাছ-লাগোয়া বারান্দায় মধ্যমণি হয়ে চেয়ারে বসে বড় জেঠু।

Advertisement

চারদিকে অন্ধকার। জেঠুর চেয়ারের সামনে হ্যারিকেনের শিখা বাতাসে দুলছে। লম্বা বারান্দায় পাটি বিছিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি আমরা। বারান্দায় মেলে দেওয়া ঠাকুমার সরু পাড়ের সাদা শাড়ি বাতাসে উড়ছে। হ্যারিকেনের আলোয় সেই অদ্ভুত ছায়া সরে সরে যাচ্ছে দেওয়ালের গায়ে। এমন একটা গা ছমছমে পরিবেশে ভাইবোনরা আবদার করলাম, ‘ও জেঠু, ভূতের গল্প বলো।’

জেঠু হাসলেন, ‘দাঁড়া, আগে একটু চা খাই।’ কিছু ক্ষণের মধ্যেই জেঠিমা রান্নাঘর থেকে জেঠুর জন্য চা আর আমাদের জন্য পেঁয়াজ-চানাচুর-লঙ্কা দিয়ে মুড়ি মেখে আনলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জেঠু শুরু করলেন, ‘সে বার বন্যার সময়ে দ্বারকা নদীর জলে রণগ্রাম সেতুর অর্ধেক ভেসে গিয়েছিল। ১৯৪২ সালে ফের সেতু তৈরির কাজ শুরু হল। নগর থেকে ছোট মামু, ইউনুস আলি খোশবাসপুর এসেছেন বেড়াতে। মামাকে সঙ্গে নিয়ে গরমের দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে রণগ্রাম যাচ্ছি। তখন বহরমপুর-কান্দি রুটে সারা দিনে হাতেগোনা দু’তিনটে বাস চলত। জনশূন্য মাঠ। কোথাও কোনও বসতি নেই। মাঝে-মাঝে শিরিষ গাছের শনশন শব্দ। রণগ্রাম সেতু নির্মাণের কাজ দেখে ফিরে আসছি। গরমের দুপুরে ওই সেতু থেকে কিছুটা দূরে একটা পুকুর দেখে স্নান করার ইচ্ছে হল। মামুকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি পুকুরে ঘাটে নামতে যাব, এমন সময় দেখি লাল পাড় শাড়ি পরে মাঝবয়সী এক মহিলা কখনও ভেসে, কখনও ডুব সাঁতার দিয়ে কী যেন খুঁজছেন। ফর্সা চেহারার ওই মহিলার মাথা ভর্তি ঘন লম্বা চুল। ডুব দিলে চুলগুলো ভেসে থাকছে জলে। পুকুরের পাঁক থেকে কিছু একটা তুলে তাঁকে খেতেও দেখলাম। গ্রীষ্মের দুপুরে জনবসতি নেই আশপাশে। সেখানে একা ওই মহিলাকে দেখে বলি—‘ও মেয়ে, তোমার বাড়ি কোথায়?’ কোনও উত্তর নেই। ভয় পেয়ে আমি ছুটে এসে মামুকে সব বললাম। মামু ও আমি দু’জনেই ফের গেলাম পুকুর পাড়ে। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। পুকুর তো বটেই আশপাশেও তন্নতন্ন করে কোথাও ওই মহিলাকে দেখতে পেলাম না।’

Advertisement

টানা গল্প বলে জেঠু চায়ের কাপ তুলে নেন। জেঠু বললেন, ‘পরে শুনেছি রণগ্রামের গোয়ালাদের বাড়ির এক মহিলা ওই পুকুরে আত্মহত্যা করে। পরে অনেকেই তাঁকে সাঁতার কাটতে দেখেছেন!’ ভাই-বোনরা চুপ করে বসে আছি। কারও মুখে টুঁ-শব্দ নেই। দমকা বাতাসে হ্যারিকেনটা গেল নিভে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন