মেয়ের বয়স মোটে পনেরো। বিয়েতে তার মোটেই মত নেই। ‘স্কলারশিপের ফর্ম’ বলে বিয়ের রেজিস্ট্রি করার কাগজে সই করানো হয়েছিল তাকে দিয়ে— এমনটীই অভিযোগ ছিল হাজি আলম বক্স সিনিয়র মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্রী সাকিনা খাতুনের।
সে বিয়ে আটকানো গিয়েছে।
গত বুধবার পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সামনে কেঁদে ভাসিয়েছে হরিহরপাড়ার সেই মেয়ে। বলেছে, সে পড়তে চায়। কর্তারা তার বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছেন, নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে। তাই শুনেই তাঁরা আপাতত পিছিয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু যিনি রেজিস্ট্রির ফর্মে সই করিয়েছিলেন, সেই নিবন্ধক মহম্মদ ওবাইদুল্লার কী হবে? কোন আক্কেলে তিনি এমন কাণ্ড করলেন?
সাকিনা খাতুনের কথা অনুযায়ী, ‘‘ছাত্রী-বৃত্তির আবেদনপত্র পূরণের নাম করে বাবা আমায় ওই বিয়ের রেজিস্ট্রারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন তো বুঝিনি যে উনি রেজিস্ট্রার। উনি আমায় বলেন, ‘বৃত্তি পেতে হলে তোমায় একটা কাগজে সই করতে হবে।’ আমি সরল মনে ওখানে সই করে দিই। খানিক পরে ছেলের বাড়ির লোকজন এসে হলে তখন মালুম হয়, কীসে সই করে বসে আছি!।’’
গোটা ঘটনা শুনে বিরক্ত মুসলিম সমাজের মাথারাই। তাঁরা বলছেন, নাবালিকা হোক বা সাবালিকা, বিয়ে দিতে হলে পাত্রীর ‘সম্মতি’ নিতেই হবে। ‘সারা বাংলা মুসলিম বিয়ে নিবন্ধক এবং কাজী সোসাইটি’র রাজ্য সভাপতি মহম্মদ মাহতাবুর রহমানের বক্তব্য, ‘‘ইসলামী মতে বিয়ে একটা পবিত্র চুক্তি। পাত্রী সব জেনে-শুনে ওই চুক্তি সংক্রান্ত নথিতে সই করেন। তাঁকে ভুল বুঝিয়ে সই করানো ইসলাম-বিরোধী কাজ। ওই রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’’
ওই সংগঠনেরই নদিয়া জেলা সভাপতি ফারুখ কাজী জানাচ্ছেন, শরিয়তি বিধি অনুযায়ী ১৫ বছর পার হলেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রাজ্য সরকার অবিবাহিত মেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করছে। কন্যাশ্রী প্রকল্পে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পে মেয়েরা সাইকেলেও পাচ্ছে। তাই এখন তাঁরা আঠারোর আগে মেয়ের বিয়ে না দেওয়ারই পরামর্শ দিচ্ছেন।
কাজীরাই বলছেন, সমস্যা বাড়ছে বিয়ের আইন সকলের ক্ষেত্রে এক না হওয়ায়। যেমন, ১৯৫৪-র ‘বিশেষ বিবাহ আইন’ ও ১৯৫৫ সালের ‘হিন্দু বিবাহ আইন’ অনুযায়ী আঠারো বছরের নীচে কোনও মেয়ের বিয়ে দেওয়া অন্যায়। কিন্তু ১৮৭৬ সালের ‘মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ নিবন্ধক আইন’ মোতাবেক ১৫ বছর বয়স হলেই মেয়েদের বিয়ে আইনসিদ্ধ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নিবন্ধককে পাত্রীর মৌখিক ও লিখিত সম্মতি নিতে হবে।
ওবাইদুল্লা শুধু যে সম্মতি নেননি, তা-ই নয়। তিনি কার্যত মেয়েটিকে ঠকিয়ে বিয়েতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ। ওবাইদুল্লা অবশ্য শুক্রবারও দাবি করেন, তিনি নির্দোষ। তাঁর দাবি, ‘‘শরিয়তি মতে বিয়ে দিতে পাত্রীর সম্মতির দরকারই নেই। তার বাবা-মা বা ঠাকুর্দা-ঠাকুমা রাজি থাকলেই চলে। মেয়েটির বাবার সম্মতি নিয়েই আমি তাকে বিয়ের আবেদনপত্রে সই করিয়েছিলাম। পরে অবশ্য বিয়েটা আর হয়নি।’’
ওবাইদুল্লার বিরুদ্ধে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
হরিহরপাড়ার বিডিও পূর্ণেন্দু সান্যাল বলেন, ‘‘ছাত্রীটি প্রতারণার কথা লিখিত ভাবে জানায়নি। লিখিত অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেব।’’