সংসার যখন নদীর বাঁধেই।— নিজস্ব চিত্র।
নৌকায় চেপে ভরতপুর-১ ব্লকের পল্লিশ্রী গ্রামে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই ঘিরে ধরলেন গ্রামবাসীরা। উগরে দিলেন এতদিনের জমিয়ে রাখা ক্ষোভ। জানালেন, কারওরই ক’দিন ধরে ভরপেট খাওয়া জুটছে না। পরণের কাপড়টুকু ভরসা করে দিন-রাত কাটছে। বাড়ি ধসে যাওয়ায় নদীবাঁধের উপরে তাঁবু খাটিয়ে চলছে বসবাস।
এমনই এক তাঁবুতে উঁকি মেরে দেখা গেল দু’বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে শুকনো মুখে বসে রয়েছেন আরতী রাজবংশী। তখনও বাড়ি বন্যায় ডুবে যায়নি। মেয়ের জন্য দু’প্যাকেট শুকনো দুধ এনে রেখেছিলেন। ‘‘তা যদি না আনতাম তা হলে মেয়েটা কিছুই খেতে পেত না।’’—ক্ষোভ ঝরে পড়ে তাঁর গলা থেকে। পাশেই ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন সুনীতা রাজবংশী। ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনিও। তিনি বলেন, ‘‘ত্রিপল নেই। খাবার নেই। তেষ্টার জলটুকুও নেই। ক’দিন ধরে বাঁধেই রয়েছি। কিন্তু কোনও নেতা-মন্ত্রী খোঁজ নিতে আসেনি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভোটের সময় নেতাদের ঘন ঘন দেখা মেলে। এখন তাঁদের টিকিটিরও দেখা মিলছে না। বাচ্চাদের নিয়ে কী ভাবে আছি সেটা আমরাই জানি। মা তো তাই কষ্ট হলেও ছেলেমেয়েদের আগলে রয়েছি।’’
বাবলা নদীর ধারে ওই গ্রাম। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো পরিবারের বসবাস। প্রায় বারো দিন হয়েছে ওই গ্রাম জলমগ্ন। গ্রামের মধ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। জল ঢুকেছে সেখানেও। তাই বাড়ি ৭০টি পরিবার নদীবাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছে।
অভিযোগ, টানা বারো দিন ঘরছাড়া তাঁরা হলেও আজও কোনও রাজনৈতির নেতা বা প্রশাসনের কর্তাকে ওই এলাকায় দেখা যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার ভরতপুর থানার পুলিশ শিশুদের জন্য দুধের প্যকেট, বিস্কুট ও গ্রামের উঁচু জায়গায় খিচুড়ি রান্না করে ওই বাঁধে গিয়ে দিয়ে আসে। তারপরে ত্রাণ বলতে মিলেছে কয়েকটি জলের পাউচ। কোথাও আবার সেটুকুও পৌঁছয়নি। বৃষ্টি ও রোদ হাত থেকে বাঁচতে মেলেনি ত্রিপল। বড়দের তো দূরের কথা শিশুদের জন্যও কোনও খাবারের ব্যাবস্থা করা হয়নি।
এক দিকে, বাবলা ও অন্য দিকে, ময়ূরাক্ষীর জলে বিলকারোল বিল উপচে ওই গ্রাম ভেসে যায়। জলবন্দি হয়ে পড়েন গ্রামবাসীরা। বাসিন্দাদের দাবি, শয়ে-শয়ে বিষধর সাপ বাঁধের উপর এসে উঠেছে। বিদ্যুতের বালাই নেই। ঘরে যেটুকু কেরোসিন ছিল সে সব শেষের পথে। সন্ধ্যা হলেই আতঙ্কে চেপে ধরে তাঁদের।
একই অবস্থা ভরতপুর-১ ব্লকের সিজগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের সাহেবনগর, আমলাই গ্রাম পঞ্চায়েতের রাধানগর, জোরগাছি, ভালুইপাড়া, আমলাইয়ের মতো গ্রামগুলির। বাসিন্দাদের অভিযোগ, জলের পাউচ না মেলায় ছোট নৌকায় চেপে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরের নলকূপ থেকে জল আনতে হচ্ছে তাঁদের। জোরগাছি এলাকার বাসিন্দা জহির শেখ বলেন, “কোনও দিন ত্রাণের খাবার আসে তো কোনও দিন আসে না। পানীয় জলেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে।’’
যা শুনে কান্দির মহকুমাশাসক বিজিন কৃষ্ণ বলেন, “প্রতিদিন প্রায় কুড়ি হাজার পাউচ জল সরবরাহ করা হচ্ছে। আর ওই ব্লকে প্রায় আট হাজার ত্রিপল বিলি করা হয়েছে। তারপরেও কেন এমন অবস্থা চলছে তা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।” তিনি আরও বলেন, ‘‘এখনও প্রায় পাঁচ হাজার লোকের খাবার রান্না করে বিলি করা হচ্ছে। তারপরেও কেন এমন অভিযোগ আসছে বুঝতে পারছি না।”
এ দিকে, বৃষ্টি থামলেও বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি কান্দি মহকুমায়। জল নামছে ধীর গতিতে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও বাবলা নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। সালার-কান্দি ও ভরতপুর-লোহাদহ রাজ্য সড়কের উপর দিয়ে জল না নামায় স্বাভাবিক হয়নি যান চলাচলও। ভরতপুর ১ ও ২ ব্লক ছাড়াও কান্দি ব্লকের প্রায় পনেরো হাজার পরিবার এখনও জলবন্দি হয়ে রয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০টি ত্রাণশিবির চলছে। প্রায় পাঁচ হাজার বাসিন্দা ওই শিবিরগুলিতে রয়েছেন। বড়ঞা ব্লকের সুন্দরপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার জাওহাড়ি, বড়ঞা, মামদপুর, বৈদ্যনাথপুরে জল নামলেও খেত থেকে জল নামেনি। বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য ভরসা সেই নৌকা।
জল না নামায় পঠনপাঠন বন্ধ বহু স্কুলে। কবে ওই স্কুলগুলিতে ফের পঠনপাঠন শুরু হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে প্রশাসনিক মহলে। ভরতপুর-১ ব্লক এলাকার বিনোদিয়া এলাকায় কান্দি-সালার রাজ্য সড়কের উপর দিয়ে জল বয়ে যাওয়ায় টানা দশ দিন ধরে ওই রুটে যানচলাচল বন্ধ। কিন্তু পর্যাপ্ত জল না থাকায় নৌকা চালানোরও কোনও উপায় নেই। তবে ভরতপুর-লোহাদহ রাজ্য সড়কের পাশের মাঠ দিয়ে নৌকার ব্যবস্থা করে বাসিন্দাদের যাতায়তের ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন।