সরলেন কল্যাণ, বিজেপি-র দায়িত্বে আশুতোষ

মুখে সদ্ভাব, আড়ালে ভয় ব্যুমেরাং চাল হবে কি না

টানা ছ’বছর দায়িত্বে থাকার পরে বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে নদিয়া জেলা সভাপতির পদ থেকে সরানো হল কল্যাণ নন্দীকে। বেশ কিছু দিন ধরে দলেরই একটা অংশ তাঁকে পদ থেকে সরাতে সক্রিয় ছিলেন বলে খবর।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৫১
Share:

কল্যাণ নন্দী, ডান দিকে আশুতোষ পাল।—নিজস্ব চিত্র।

টানা ছ’বছর দায়িত্বে থাকার পরে বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে নদিয়া জেলা সভাপতির পদ থেকে সরানো হল কল্যাণ নন্দীকে। বেশ কিছু দিন ধরে দলেরই একটা অংশ তাঁকে পদ থেকে সরাতে সক্রিয় ছিলেন বলে খবর। ‘কল্যাণবাবুকে সরিয়েও দেওয়া হয়েছে’ বলে জেলায় একাধিকবার গুজবও ছড়ায়। কিন্তু, প্রতিবারই ‘শত্তুর মুখে ছাই’ দিয়ে স্বপদে থেকে গিয়েছিলেন। এমনকী সভাপতি হিসাবে মেয়াদ শেষের পরেও রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এই নেতাকে পদে রেখে দিয়েছিল রাজ্য কমিটি।

Advertisement

সামনে বিধানসভা ভোট। তার আগে কল্যাণবাবুকে সরিয়ে আরএসএস ঘনিষ্ঠ আশুতোষ পালকে সভাপতি করায় দলের অন্দর থেকেই দু’রকম প্রতিক্রিয়া উঠে আসছে। জেলা কমিটির সদস্যদের একাংশ ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছেন, রদবদল প্রসঙ্গে আপত্তির কথা তাঁরা সরাসরি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানাবেন। জেলা বিজেপির আর একটা অংশ অবশ্য উচ্ছ্বসিত। তাঁদের অনেকেই বলছেন, ‘‘তা হলে শেষ পর্যন্ত সরানো গেল জগদ্দল পাথরকে!’’

জেলা কমিটির এক নেতার কথায়, ‘‘কল্যাণদা যখন দায়িত্ব নেন তখন দলের সদস্য মাত্র ১৪ হাজার। সেটা বেড়ে তিন লাখ হয়েছে। গত উপনির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে লড়াই করে দল সিপিএমকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। লোকসভা ভোটে রানাঘাট কেন্দ্র থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ভোট পেয়েছে।’’ অন্য এক নেতা জানান, কল্যাণবাবুর কৃতিত্বেই কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি-র ভোট পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে পঁয়ত্রিশ শতাংশ হয়। রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন জেলা সভাপতি স্বয়ং। সেখানেও একক কৃতিত্বে ৪৯ হাজার থেকে ভোট বাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আড়াই লক্ষে। এমন সংগঠককে সরিয়ে দেওয়ায় নিচুতলার কর্মীদের মনোবলে আঘাত লাগতে পারে বলে তাঁর মত।

Advertisement

বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, যাকে কল্যাণ নন্দীর একক সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে, সেটা পুরোপুরি তাঁর কৃতিত্ব নয়। লোকসভা নির্বাচনের সময়ে তৈরি হওয়া ‘মোদী-ফ্যাক্টর’ও সমান সক্রিয় থেকেছে। এক নেতার কথায়, ‘‘লোকসভা ছাড়া অন্য কোনও ভোটে জেলায় বিজেপি ন্যূনতম দাগটুকুও কাটতে পারেনি। অথচ তিনি তো টানা ছ’বছর দায়িত্বে ছিলেন! ক’দিন আগেই জেলায় কিছু আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। সেখানেও বিজেপি-র সাফল্য কই! একই ধারা বজায় থেকেছে পুরভোটেও।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এর ব্যর্থতার দায় কল্যাণবাবু কি নিয়েছেন? তা হলে পুরনো সাফল্য টেনে এত ঢাক পেটানো কেন?’’

গত অগস্ট মাসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল কল্যাণবাবুর মেয়াদ। তিনি টানা দু’বারের জেলা সভাপতি। সেই জায়গায় তাঁর কোনও অনুগামীকে বসানোর চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ২০০৯ সালে কল্যাণবাবু সভাপতি পদে বসার পর থেকে একে একে তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকদের সরিয়ে সেখানে অনুগামীদের বসানোর অভিযোগ উঠেছিল কল্যাণবাবুর বিরুদ্ধে। কোণঠাসা অবস্থায় ছিল বিরোধী শিবির। বিশেষ করে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় তথা জলুবাবুর অনুগামীদের করুণ হাল হয়। এই পরিস্থিতিতে কল্যাণবাবুকে সরিয়ে দেওয়াই নয়, সেই জায়গায় বসানো হল বিরোধী গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত আশুতোষ পালকে। রাজনৈতিক মহলের মত, এটা কল্যাণ-শিবিরের কাছে জোড়া ধাক্কা সন্দেহ নেই।

এমনিতেই, কল্যাণবাবুর সঙ্গে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় ওরফে জলুবাবুর সম্পর্ক কোনও দিন মধুর ছিল না। এমন আবহে আশুতোষ সভাপতি হওয়ায় জলুবাবুরই জয় দেখছেন অনেকে। এই সরলীকরণ অবশ্য মানতে রাজি নন কল্যাণবাবুর অনুগামীরা। তাঁদের সাফ কথা, ‘‘জুলুবাবুর ক্ষমতায় এটা হয়নি। তা হওয়ার হলে অনেক আগে হত।’’ তা হলে? কল্যাণ-শিবিরের মত, নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে আরএসএস। কারণ, কল্যাণবাবুর সঙ্গে স্থানীয় আরএসএস এর সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না।

নেতার সরে যাওয়ায় প্রমাদ গুণতে শুরু করেছেন বিভিন্ন পদে থাকা ঘনিষ্ঠেরা। এত দিন যে ভাবে বিরুদ্ধ গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করে কল্যাণবাবুর ও তাঁর অনুগামীরা দল পরিচালনা করে এসেছেন এ বার তা ‘ব্যুমেরাং’ হতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের। তবে প্রকাশ্যে কেউই কিছু না বলে পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে চাইছেন।

নতুন জেলা সভাপতি আশুতোষ পাল অবশ্য সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘দল দায়িত্ব দিয়েছে। আমি সকলকে নিয়েই এগিয়ে যাব।’’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাঁর সংযোজন, ‘‘কল্যাণবাবু দলের দীর্ঘ দিনের নেতা। দু’বারের সভাপতি। তাঁকে পাশে বসিয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে দল পরিচালনা করতে চাই।’’ যা শুনে সদ্য প্রাক্তন জেলা সভাপতি কল্যাণবাবুও আশুতোষের পাশে থাকার কথাই বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আশুতোষ জেলা কমিটির সহ সভাপতি ছিল। সে যখন সাহায্য চাইবে, আমি তখনই ওর পাশে থাকব। কেননা দলই শেষ কথা।’’

সভাপতি পরিবর্তনে খুশি গোপন করেননি জলুবাবু। তিনি বলেন, ‘‘এই পরিবর্তনে খুশি। নতুন সভাপতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল। ওকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।’’ কেন রদবদল করতে হল? জুলুবাবু বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটে উনি অসহযোগিতা করেছিলেন। তবুও বলব নতুন সভাপতি যেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলেন।’’ সামনেই বিধানসভা ভোট। কল্যাণবাবুকে সরিয়ে দেওয়ায় তাঁর অনুগামীরা কতটা সক্রিয় থাকবেন বা তাঁদের নতুন সভাপতি বা তাঁর অনুগামীরা আদৌ কতটা গুরুত্ব দেবেন সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন