হাত বিশেক দূরে গর্জন করছে পদ্মা। হাওয়ায় বেপরোয়া চুল সামলে এক্রাম আলি বলছেন, ‘‘রকমফের অনেক হল কর্তা, তবে ভেলাটা এক্কারে লা জবাব!’’
পুলিশ-বিএসএফের চোখে ধুলো দেওয়ার নানান ফন্দি ফিকিরের এই শেষতম কৌশলটা যে একেবারে ল্যাজে গোবরে করে ছেড়েছে সীমান্তের প্রহরা, মেনে নিচ্ছেন বিএসএফের কাহারপাড়া ক্যাম্পের অফিসারও, ‘‘একদাম বুড়বাক বানাকে ছোড় দিয়ে হমলোগোকো!’’
কলার ভেলার আড়ালে মাঝারি আকারের গরু নিমিষে হারিয়ে যাচ্ছে স্রোতে, প্রথম চোটে ধরতেই পারেননি বিএসএফের সদ্য বদল হওয়া ব্যটেলিয়ন। রাত জেগে নদীর পাড়ে গরু পাচারের সাবেক কলা কৌশল রোখার জন্য মরিয়া জওয়ানেরা বুঝতেই পারেননি ইদের বাজারে ভরা পদ্মায় ভেসে গরুর পাল কি করে ও কূলে গিয়ে উঠছে!
শুধু কলার ভেলা নয়, সেই তালিকায় রয়েছে পাটের আঁটির ভেলাও। সীমান্তের মাঠে কান পাতলে তার একটা দরও পাওয়া যাচ্ছে। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিকিয়ে যাচ্ছে পাট। আর তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিব্যি তৈরি হচ্ছে একটা ভেলার মতো ভাসমান দরিয়া পাড়ি দেওয়া পাটাতন। কলার ভেলার মতো তাতেও মাঝখানটা কেটে মুখটুকু বের করে রেখে সাঁতরে চলেছে গরুকুল।
সামনেই কোরবানির ইদ। ফলে গরু-মোষের দাম স্বাভাবিকের থেকে চার গুণ দাম বেশি বাংলাদেশের বাজারে। পুলিশের কাছে যা খবর, এক একটা বড় গরু দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা দামে অনায়াসে বিকোচ্ছে সেখানে। এ পাড়ে যার দাম মেরেকেটে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার।
এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘এখন প্রায় সব পথ বন্ধ। বিএসএফের নজরও কড়া। ফলে পদ্মাই এখন শেষ আশ্রয় পাচারকারীদের! জল বাড়ছে হুহু করে। ভেলার মাঝে গোটা চারেক গরু গুঁজে দিতে পারলেই ভাগ বাঁটোয়ারারা পরেও লাখপতি!’’
ডোমকলের এক পুলিশ কর্তা কবুল করছেন, ‘‘দেখুন কাণ্ড, এত দিন সীমান্তের পথঘাট পাহারা দিচ্ছিলাম, ট্রাক থেকে মারুতি ভ্যান সবেই উঁকি মেরে দেখেছি, গরু যাচ্ছে কিনা। এখন উঁকি দিচ্ছি কলা বা পাটের আঁটি চলল না তো!’’
কিন্তু ঢালাও কলা খেত বিক্রি করে লাভ থাকছে? রানিনগরের একটি কলা বাগানের মালিক বলছেন, ‘‘এক কাঁদি কলা বিক্রি করে বড়জোর ১০০ থেকে ১২০ টাকা দাম পায় চাষি। অথচ দেখুন, বড় মোটা বেড়ের গাছ হলেই ১৫০ টাকা। আর বেঁটে খাটো হলেও কমপক্ষে ১০০ টাকা। ফলে কলা না বেচে গাছ বেচব না কেন!’’
তা ছাড়া গাছ জমিতে থাকলে তার লালন পালনে হ্যাপাও ঢের। পরিচর্যা থেকে চোরের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রহরা বসানো, কম ঝক্কি নয়। পাট চাষির ক্ষেত্রেও, পাটা কাটা থেকে ছাড়ানো তাকে শুকিয়ে ঘরে মজুত রাখা— কম হ্যাপার কাজ নয়। ফলে জমি থেকে চড়া দরে বেচে দিতে পারলে ক্ষতি কি।
রানিনগরের ওসি অরুপ রায়ের এখন দিন-রাত এক হয়ে গিয়েছে— ‘‘আমাদের অফিসার থেকে সিভিক, ঘুম নেই কারও। রাতে কোন পথে কলা গাছ নিয়ে ট্রাক্টর ছুটছে কোন জমির পাট রাতারাতি পদ্মায় ফেলা হচ্ছে, এই দেখতেই শেষ হয়ে গেলাম।’’