ভাইফোঁটায় স্বজন চিনল হোম-বালক

পূজা, শর্মিষ্ঠা আর নেহা— তিন জন ছোট্টবেলা থেকে বন্ধু। দু’জনের নিজের ভাই বা দাদা নেই, এক জনের দাদা থাকলেও কর্মসূত্রে বাইরে। তা বলে কি ভাইফোঁটা দেবে না?

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭ ০১:৪৩
Share:

ফোঁটার-সকাল: পুলিশকর্মীদের ফোঁটা। বহরমপুরে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

সম্পর্ক তো কেবল রক্তের হয় না, ভালবাসারও হয়।

Advertisement

সকাল-সকাল স্নান সেরে প্রদীপ, ধান-দুব্বো, লুচি-মিষ্টি নিয়ে তিন বন্ধু চলে এসেছিল করিমপুরে পাটাবুকার অনাথ আশ্রমে।

পূজা, শর্মিষ্ঠা আর নেহা— তিন জন ছোট্টবেলা থেকে বন্ধু। দু’জনের নিজের ভাই বা দাদা নেই, এক জনের দাদা থাকলেও কর্মসূত্রে বাইরে। তা বলে কি ভাইফোঁটা দেবে না?

Advertisement

কত দিন ধরে তারা টিফিন খরচ, সাজের খরচ বাঁচিয়ে টাকা জমিয়েছে। তাতেই তো সব বন্দোবস্ত। সকালেই তারা হাজির আশ্রমে, তিরিশ জন অনাথ শিশুকে ফোঁটা দেবে। সে এক হইচই কাণ্ড!

ফোঁটা দিয়ে পূজা-নেহারা বলে, ”এই ছোট-ছোট ভাইগুলোকে ফোঁটা দিতে পেরে অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। কী যে ভাল লাগছে!” ফোঁটা নিয়ে আপ্লুত রাহুল-দীপেরা। তাদের কথায়, “ভাইফোঁটা কী জিনিস, তা-ই তো জানতাম না এত দিন। কেউ কখনও দেয়নি। আজ দিদিদের হাতে ফোঁটা নিয়ে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।”

কৃষ্ণনগরের শঙ্কর মিশনে আবার ভোর হতেই ব্যস্ত ছেলের দল। ভোরে উঠেই স্নান সেরে ধোপদুরস্ত জামা-কাপড় পরে পরিপাটি চুল আঁচড়ে তারা তৈরি। আশ্রম থেকে বেরিয়ে জোগাড় করে এনেছে দুব্বোও।

কৃষ্ণনগরের একপ্রান্তে এই শঙ্কর মিশন। এখন আবাসিক শিশুর সংখ্যা ১৬০। পুজোয় অনেকেই বাড়ি ফেরে। যাদের কেউ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার নেই, তারাই রয়ে গিয়েছে। তাদের ফোঁটা দেওয়ার জন্য প্রতি বারই এসে হাজির হয় দেবলীনা, পম্পা, সুদীপ্তা, অন্তরা। প্রায় ২২ বছর ধরে চলছে এই ভাইফোঁটা।

বছর সতেরো আগে সেই কবে মণীন্দ্রনাথ রায়কে এই আশ্রমে রেখে গিয়েছিলেন তার মা। সেই থেকেই সে এখানে। তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দিয়েছিল মহারাজ। এখন সে বিএ পাশ করে চাকরির সন্ধানে। কিন্তু ফি বারই ভাইফোঁটার সকালটা এলেই সে অস্থির হয়ে পড়ে। কিছুতেই বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না। বোন-দিদিরা যে আসবে ফোঁটা দিতে।

এই দিদি-বোনদের কারও ভাই নেই, আবার কেউ বা ইচ্ছা থাকলেও পারিবারিক সংস্কারের কারণে বাড়িতে ভাইফোঁটা দিতে পারে না। এখানে ভাইফোঁটা দিয়েই কেউ আবার ছুটতে থাকে বাড়ি। নিজের ভাই অপেক্ষা করে আছে যে! দেবলীনা বলেন, “আমার ভাই নেই, আর এদের নেই দিদি। একটা দিন তাই এদের দিদি হয়ে উঠতে চাই প্রতি বছর।”

মায়ানমারে অত্যাচারিত হয়ে বছর দুয়েক আগে ভারতে পালিয়ে আসার সময় বিএসএফ-এর হাতে সপরিবার ধরা পড়ে গিয়েছিল রোহিঙ্গা কিশোর মহম্মদ জুবের। পরে তার ঠাঁই হয় বহরমপুরের ‘আনন্দ-আশ্রম’ হোমে। মা আয়েষা আছেন এই শহরেই কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে আর দুই দিদি আছে ‘শিলায়ন’ হোমে।

‘শিলায়ন’ হোমের অন্য দিদিদের হাতে ভাইফোঁটা নিতে সকালেই স্নান সেরে তৈরি জুবের। বাংলাদেশের কিশোর শফিকুল শেখ আবার দিদির বাড়ি থেকে ফেরার সময় বিএসএফ-এর হাতে ধরা পড়েছিল। এখন সে আনন্দ-আশ্রম হোমের আবাসিক। এ বারই প্রথম ভাইফোঁটা পেল সে। পেয়ে মহা খুশি।

প্রাণের টানে জাত-ধর্মের বাঁধন যে কোথায় ভেসে গেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন