দেবতার পা ছুঁইয়ে আনা হত হালখাতা

বাংলা বছর শুরুর দিনে ওঁদের গতিবিধি যেত পাল্টে। ওই একটা দিন সকালের বদলে রাতে দল বেঁধে ভিক্ষায় বার হতেন ওঁরা। 

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৪৫
Share:

বাংলা বছর শুরুর দিনে ওঁদের গতিবিধি যেত পাল্টে। ওই একটা দিন সকালের বদলে রাতে দল বেঁধে ভিক্ষায় বার হতেন ওঁরা।

Advertisement

হবে নাই বা কেন? তখন সবে নবদ্বীপ বিজলিবাতি এসেছে। নববর্ষের রাতে শহরের অভিজাত বস্ত্র এবং স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দোকানে জ্বলত বিজলিবাতির ‘ডুম’। চারপাশে কার্বাইড গ্যাস বা ডেলাইটের ম্যাড়ম্যাড়ে আবছায়ার মাঝে কয়েকটা ব্যতিক্রমী দোকান উজ্জ্বল হলদেটে আলোয় ঝলমলিয়ে উঠত। চেনা হাটবাজার অচেনা হয়ে উঠত। নববর্ষের সেই রাতে ভিক্ষুকেরা দলবেঁধে ভিক্ষায় নামতেন। তবে এ রাতে তাঁরা কেবল দোকানেই যেতেন। সে কালের ব্যবসায়ীরা তাঁদের জন্যও মিষ্টির ব্যবস্থা রাখতেন। প্রাচীন জনপদ নবদ্বীপে নববর্ষ আসত অন্য ভাবে। বছরের প্রথম ভোরে গঙ্গায় স্নান করা ছিল অবশ্য কর্তব্য। তার পর ব্যবসায়ীরা হালখাতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কেউ পোড়ামা মন্দিরে, কেউ বা মহাপ্রভু মন্দিরে যেতেন হালখাতা দেবতার পায়ে ছুঁইয়ে আনার জন্য। নববর্ষের সকালে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে পুরোহিতের পাশে বসে গণেশ পুজোর শেষে লাল কাপড়ে জড়ানো হালখাতায় সিঁদুর মাখানো টাকার ছাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন বছরের প্রথম উৎসবের সুরটি বাঁধা হয়ে যেত।

সাধারণ গৃহস্থ বছরের প্রথম দিনে ভাল-মন্দ খাওয়ার জন্য বাজারে ছুটতেন আর সন্ধ্যার পর ভিড় বাড়ত বাজার তথা দোকানে দোকানে। তবে সে কালে প্যাকেটের ব্যবস্থা ছিল না। দোকানে গ্লাসে করে দিত নানা ধরনের সরবত। আমপোড়া, বেল, তরমুজের সরবতের সঙ্গে লস্যি বা টাটকা ডাবের জল দিয়ে আপ্যায়ন করা হত দোকানে আসা অভ্যাগতদের।

Advertisement

আপ্যায়ন আর আশীর্বাদে ভরা সে কালের নববর্ষের সঙ্গে আজকের ‘পয়লা বৈশাখ’কে মেলাতে পারেন না নবদ্বীপের সে কালের ব্যবসায়ীরা। প্রবীণ ব্যবসায়ী নিরঞ্জন দাস সে কথা বলতে গিয়ে জানান, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে নবদ্বীপের তাঁত ও সুতোর রমরমা ব্যবসা ছিল। গোটা রাজ্য থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন এখানে। নববর্ষের দু’দিন আগে থেকে বড় বড় ব্যবসায়ীর বাড়িতে মিষ্টির ভিয়েন বসত। রসগোল্লা, পানতোয়া আর সন্দেশ তৈরি হত। পয়লা বৈশাখ সকাল থেকে শুরু হত পোলাও রান্না। সারা দিন ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন। বসিয়ে খাওয়ানো হত পোলাও এবং মিষ্টি।” নববর্ষের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে দিন গড়িয়ে মাঝরাত কাবার। প্রচুর মানুষ আসতেন। না এলে রীতিমতো রাগারাগি।

নববর্ষের খাওয়াদাওয়া ঘিরে প্রবীণদের অনেক স্মৃতি এখনও এই দিনে ফিরে ফিরে আসে। নবদ্বীপ পুরসভার কাউন্সিলর নির্মল দেবের আদি বাড়ি ছিল নাটোর। সেখানকার রায় আমহাটি গ্রামে পয়লা বৈশাখের মেনুতে টকের তরকারি থাকতই। নির্মলবাবু বলেন, “এত দিন পরেও সেই সব তরকারির স্বাদ যেন জিভে লেগে আছে।”

একই ভাবে নববর্ষের দুপুরের যশুরে কইমাছের ‘তেলকই’ আর ইলিশের মাথা দিয়ে ‘মুড়িঘণ্টের’ গন্ধ যেন এখনও নাকে লেগে আছে নব্বই ছুঁই-ছুঁই বীণাপাণি নন্দীর। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই এ বঙ্গের বাসিন্দা যশোরের বীণাপানি দেবীর পয়লা বৈশাখ এলে মনে করেন তার কথা। ইলিশের মাথা আর গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে মুড়িঘণ্ট। শেষপাতে ঘরে পাতা সাদা দই।

নববর্ষের সন্ধ্যায় মন্দিরে গিয়ে মহাপ্রভুকে প্রণাম করা সে কালের অবশ্য পালনীয় রীতি ছিল। পুরনো বাসিন্দারা সে প্রথা মানলেও নতুন প্রজন্ম এসবের মধ্যে নেই। কীর্তনীয়া সরস্বতী দাস বলেন, “বছরের প্রথম দিনে মহাপ্রভুকে কীর্তন শোনানোরও রেওয়াজ ছিল। কীর্তনীয়ারা গঙ্গাস্নান সেরে মহাপ্রভু বাড়ির নাটমন্দিরে প্রভাত কীর্তনের আসর জমিয়ে তুলতেন। আমি যাই। কিন্তু আর কাউকে দেখি না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন