আশ্বিন ফুরোলে হেমন্ত গায়ে মেখে ফেরে ওরা

বছর দশটা মাস ঘরের কাছে ধু-ধু চরের মাঠেই চরে বেড়ায় গরু-মোষের পাল। রাতে দু’এক জনকে পাহারায় রেখে বাকিরা বাড়ি ফেরেন। কিন্তু এই আশ্বিনের এই সময় ওই চরেই কলাই চাষ হয়। কলাই বড় বালাই!

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক

করিমপুর শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০২:৩১
Share:

খোলা আকাশেই দিবারাত্রি। নিজস্ব চিত্র

তৃণই মূল কারণ!

Advertisement

আর সেই সবুজের খোঁজে পুজোর মুখে চেনা চরাচর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন ওঁরা। পিছনে পড়ে থাকে চণ্ডীমণ্ডপ, নদীপাড়ের কাশবন, প্রিয়জনেরা। ওঁরা হাঁটতে থাকেন। সঙ্গে হাঁটে শ’য়ে শ’য়ে গরু-মোষ।

আচমকা সামনে থাকা লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘‘ঘাস পেয়েছি গো! ওই যে দূরের মাঠে সবুজ আর সবুজ।’’

Advertisement

বছর দশটা মাস ঘরের কাছে ধু-ধু চরের মাঠেই চরে বেড়ায় গরু-মোষের পাল। রাতে দু’এক জনকে পাহারায় রেখে বাকিরা বাড়ি ফেরেন। কিন্তু এই আশ্বিনের এই সময় ওই চরেই কলাই চাষ হয়। কলাই বড় বালাই! গরুরা জমিহারা, তাদের সঙ্গে ভিটেছাড়়া মালিকেরাও। কোথায় খাসজমি ভরে আছে ঘাসবনে, তালাশ করে তাঁদের ঘুরতে হয় তেপান্তরে।

মাসখানেক আগে রানিনগর থেকে মোহনগঞ্জের গরু-মোষের দল যেমন হাজির হয়েছে মুরুটিয়া কেচুয়াডাঙায়। দিনভর মাঠে-মাঠে তাদের চরানোর পরে সেই মাঠেই খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাচ্ছেন গোপালকের দল। এঁদেরই এক জন সমর ঘোষের কথায়, ‘‘আমাদের বাপ-ঠাকুর্দারাও এ ভাবেই বছরে দেড় মাস বাড়ি ছেড়ে গরু নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।’’

শুধু মোহনগঞ্জ গ্রামেই প্রায় চার হাজার গরু-মোষ রয়েছে। জলঙ্গিতেও রয়েছে অনেক গরু। ষাটোর্ধ্ব সুকুমার ঘোষের গলায় বিষাদ, “প্রতি বার পুজোতেই আমাদের বাড়িঘর ছেড়ে রোদে-জলে খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকতে হয়। সকালে মাঠের মাঝে চাল ফুটিয়ে সেদ্ধভাত খেয়ে গরু চরাতে বেরিয়ে যাই। সারা দিন মাঠে-মাঠে ঘুরে যেখানে সন্ধ্যা হয়, সেখানেই রাত কাটাই। রাতে শুকনো খাবার খেয়ে চট পেতে ঘুমিয়ে পড়ি। বৃষ্টি এলে উঠে ছাতা মাথায় বসে থাকি। অন্য উপায় নেই।’’

ওঁদের এক-এক জনের চল্লিশ-পঞ্চাশটি করে গরু বা মোষ রয়েছে। বাড়িতে খাবার দিয়ে দেড় মাস তাদের পোষা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই এই যাযাবরের জীবন। সুকুমারের দুই ছেলে সেনাকর্মী। ‘‘এ ভাবে গরু নিয়ে বাইরে থাকা ওদের পছন্দ নয়। বাড়ির সকলেই বারণ করে। কিন্তু কী আর করব’’— বলেন তিনি।

নিজের পঁচিশটি গরু নিয়ে চরাতে এসেছে বছর কুড়ির মৃত্যুঞ্জয় ঘোষও। সে বলে, ‘‘আগে বাবা আসতেন। আমরা বাড়িতে আনন্দ করতাম। গত বছর থেকে আমি আসছি। পুজোর চার দিন ভাগাভাগি করে এক-এক জন বাড়িতে কাটিয়ে আসব। কেউ সপ্তমীতে, কেউ নবমীতে।’’

রোজ সকালে মাঠ থেকে গাড়িতে দুধ যায় মোহনগঞ্জে। ওই গাড়িতেই যাওয়া-আসা। মনখারাপ করে লাভ নেই। ওঁদের শুধু আশ্বিন কেটে যাওয়ার অপেক্ষা, যে দিন বাড়ি থেকে ফোন আসবে— ‘চরের ফসল উঠে গিয়েছে। বাড়ি এসো।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন