খেলা: মোবাইলে মগ্ন। —নিজস্ব চিত্র।
খটকাটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছিল না দিনু কুণ্ডুর। ছোঁড়াগুলো যখন সাইকেল ভাড়া নিয়েছে তখন সবে বিকেল। আর এই সন্ধ্যের মুখে এসে এক ঘণ্টা হয়েছে বলে আটআনা ভাড়া ঠেকিয়ে চলে গেল।
নিজের মনেই গজগজ করছিলেন ষ্টেশন লাগোয়া সাইকেল গ্যারেজের মালিক দীনবন্ধু কুণ্ডু। তাঁর ছিল খানকতক ছোট সাইকেল। সেগুলো ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া নিয়ে চালাত ছোটরা। ঘণ্টা পিছু আট আনা ভাড়া। গরমের ছুটি পড়লেই সাইকেল ভাড়ার ধুম পরে যেত। দিনু কুণ্ডু ঘড়ি দেখতে জানতেন না। স্কুলের ছেলেরা দু’তিন জন মিলে একটা সাইকেল ভাড়া করে এক ঘণ্টার জায়গায় দেড়-দু’ঘণ্টা কাটিয়ে দিত। ফেরত দেওয়ার সময় তাই গোঁজামিল ভরসা।
‘‘দিনু কুণ্ডুকে কত বেশি সময় ফাঁকি দিয়ে সাইকেল চালাতে পারলাম সেটাই ছিল মজা। আসলে আমাদের ছোটবেলায় আনন্দের উপকরণ খুব বেশি ছিল না। তবে যেটুকু ছিল, একেবারে চেটেপুটে নিতাম।’’ সিক্সে পড়া নাতির অদ্ভুত দর্শন সাইকেলটা দেখে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল দিলীপ চট্টোপাধ্যায়ের।
সে সময়ে ছোটদের হাতে ছিল না কোনও দামি খেলনা কিংবা হালের স্মার্টফোন। ‘গেমস’ শব্দটার দেখা মিলত ইংরাজি বইতে। গাঁয়েগঞ্জে অদ্ভুত সব খেলায় ছোটবেলা কাটত। লেত্তি ঘোরানো লাট্টু কিংবা ইঁটের টুকরো সাজিয়ে তুমুল ‘পিট্টু’। সাইকেলের বাতিল টায়ার গড়িয়ে দিয়ে লাঠির ঘায়ে তাকে নিয়ে এবড়ো খেবড়ো বনবাদার পেরিয়ে দল বেঁধে ছুটে যাওয়া। ‘চাকা চালানোর’ খেলায় জয়ী সেই, যার চাকা যত দেরিতে ব্যালেন্স হারাবে।
ছোটাছুটির শেষে একটা ‘লেবু লজেন্সের’ জন্য ছটফট করত প্রাণটা। পাঁচ বা দশ পয়সার একটা হজমি বা লেবু লজেন্স পাওয়ার জন্য কত সাধ্য-সাধনা, কত ত্যাগ যে স্বীকার করতে হত, ভাবতেই পারবে না হটডগ, বার্গার, পিৎজায় অভ্যস্ত আজকের ছোটরা। “আসলে আমাদের সময়ে অধিকাংশ বাড়িতেই অনেক তুতো ভাইবোন এক সঙ্গে বড় হতাম। ছোটদের হাতে টাকাপয়সার প্রশ্নই উঠত না,” বলছিলেন নবদ্বীপের বাসিন্দা শান্তিরঞ্জন দেব। বরং বরফের গোলা সম্পর্কে বড়দের সতর্কীকরণ এখনও মনে আছে, ‘ওগুলো কিন্তু নর্দমার জল দিয়ে তৈরি হয়’। কিন্তু সহজ-সরল শৈশবে মাথায় ঢুকত না, কলের জল থাকতে কেন কষ্ট করে নর্দমার জল ব্যবহার করা হবে।
‘‘এখন ছবিটা ঠিক উল্টো। একমাত্র সন্তানের খুশির জন্য বাবা-মা কী যে করবেন, বুঝতে পারেন না। আর এত কিছু পেয়ে ছোটরাও এখন খুশি হতে ভুলে গেছে।’’ —পঞ্চাশ বছর ধরে ছোটদের সংগঠন মনিমেলা চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে এমনটাই মনে করেন শান্তিরঞ্জন দেব।
গরমের ছুটিতে সব চেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল লুকোচুরি খেলা। নিঝুম দুপুরে জেমো রাজবাড়ি লাগোয়া বাগানে লুকোচুরি খেলতে গা ছমছম করত। বলছিলেন বিমলানন্দ রায়। ‘বিশেষ করে সবাই লুকিয়ে পড়ার পরে প্রায় জনশূন্য রাজবাড়ির আনাচকানাচে তাঁদের খুঁজে বের করার সময় কেমন ভয় ভয় করত। ওই ভয় পাওয়াতেই ছিল লুকোচুরির আসল মজা।’ সেই মজাটা পেলই না ‘টেম্পল রান’ কিংবা ‘ক্যান্ডি ক্র্যাশে’ ব্যস্ত ছোটরা। বিমলবাবুর গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।