নদিয়া-মুর্শিদাবাদ সীমান্তের আটপৌরে খেলার মাঠগুলির দখল নিয়েছে রাতের ফুটবল। ছবি: সংগৃহীত।
জলসা বা যাত্রাপালার দিন শেষ। দুর্গাপুজো এগিয়ে আসতেই এখন হদ্দ মফস্সল, মুর্শিদাবাদের ডোমকল-ইসলামপুর থেকে কাঁটাতারের গা ঘেঁষা মুরুটিয়ার মাঠ কাঁপাচ্ছে ফুটবলের রাতজাগানিয়া আসর। এ পাড়া থেকে ও পাড়া, টোটো ভ্যানে চোঙা ফুঁকে চলছে প্রচার— ‘‘নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার এসেছে। অগ্রিম টিকিট কাটুন।’’ চায়ের দোকানে, মাচায়, মাঠেও শুরু জোর চর্চা।
—শুনলাম, নাইজেরিয়ার তিন জন আছে। তবে কুড়ির নীচে কেউ নেই।
—আরে, লোক ভরাতে আনছে!
—না, না। এই বগাদের নিশানা পাক্কা। বল জালে জড়াতে পারে। আর এক-একটার যা চেহারা! ঠেলা দিলেই ছিটকে পড়বে কালুরা।
—খচ্চা আছে! এমনি এমনি নাকি!
গত জুলাই থেকে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ সীমান্তের আটপৌরে খেলার মাঠগুলির দখল নিয়েছে রাতের ফুটবল। আর এই খেলাকে ঘিরে এত হইচই-উন্মাদনার প্রধান কারণই— বিদেশি ফুটবলার। কেউ এসেছেন নাইজেরিয়া থেকে, কেউ নামিবিয়া, কেউ ঘানা, কেউ আবার ত্রিনিদাদ। বিভিন্ন ক্লাব সূত্রেই খবর, এই বিদেশিদের নিয়ে আসতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয় প্রতি বছর! এখানেই বেধেছে গোল। ঘানা, নাইজেরিয়া থেকে আসা বিদেশিরা কি আদৌ এ ভাবে গ্রাম-মফস্সলের প্রতিযোগিতায় খেলতে পারেন? তাঁদের সঙ্গে পাড়ার ক্লাবগুলির টাকাপয়সার যা লেনদেন হয়, তা কি আইনত বৈধ? এই সব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও ডোমকল, হরিহরপাড়া, ইসলামপুরে নৈশ ফুটবলের ছবিটা এমন ছিল না। তখন গ্রামের ছেলেরাই ফুটবল খেলতেন। তাঁদের দেখতেই বাঁশের গ্যালারিতে ভিড় করত গোটা গ্রাম। গলা ফাটাত তাঁদের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থা বদলেছে। প্রতিযোগিতাকে আরও চমকপ্রদ করে তুলতে, মাঠে লোক টানতে ধীরে ধীরে বিদেশি ফুটবলারদের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। বছর পাঁচ-ছয়েক আগে পাড়ার ক্লাবকর্তাদের সেই কৌশল এখন দস্তুরে পরিণত হয়েছে। এখন ফুটবলের মরসুম এলেই মুখে মুখে ঘোরে অ্যারেন্ত পাওলো, মার্কেন ডি সুজা, লুসি স্যামুয়েল, সুজা কোনিদের নাম। ডোমকলেরই একটি ক্লাব সূত্রে খবর, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর অনেকেই টুরিস্ট বা স্টুডেন্ট ভিসায় কলকাতায় আসেন। ‘এজেন্ট’দের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এক এক জন খেলোয়াড়ের দর ওঠে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে যাতায়াত ও খাওয়া খরচ।
ক্লাবকর্তারা অবশ্য এ কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে নারাজ। তাঁদের দাবি, বিদেশি খেলোয়াড়দের আমন্ত্রণ করে ডেকে এনে খেলানো হয়। আয়োজকরা খুশি হয়ে তাঁদের বকশিস দেন মাত্র। অগ্রিম টাকা নিয়েই মাঠে নামেন ফুটবলারেরা। ডোমকলের এক ক্লাবকর্তা বলেন, ‘‘যে ভাবে সিনেমা কিংবা সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের আনা হয় গাঁয়ের নাইট কিংবা যাত্রাপালায়, সেই ভাবে আমরাও কলকাতা থেকে নাইজেরিয়া, ঘানা কিংবা উগান্ডার খেলোয়াড়দের নিয়ে আসি।’’ একই কথা বলেন মুর্শিদাবাদে খেলতে আসা নাইজেরীয় স্ট্রাইকার অ্যান্টনি বারির ‘এজেন্ট’ অচিন্ত্য প্রধান। তাঁর কথায়, ‘‘বেশির ভাগই পড়তে আসেন এখানে। পড়ার খরচ চালাতে ওঁরা নানা জায়গায় খেলে বেড়ান। আমরা যোগাযোগ করিয়ে দিই। এটুকুই। ওঁরা কেউ পারিশ্রমিক পান না। উপহার দেওয়া হয়।’’
ভারতীয় ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ‘অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন’-এর নতুন নিয়ম অনুযায়ী, আইএসএল বা আই লিগের ক্লাব ছাড়া কোনও ক্লাব বা সংস্থাই বিদেশি ফুটবলারদের আমন্ত্রণ করে এই দেশে আনতে পারবে না। স্টুডেন্ট বা ট্যুরিস্ট ভিসায় কোনও ভাবেই মিলবে না স্থানীয় স্তরে খেলার ছাড়পত্র। একমাত্র রেজিস্ট্রেশন করানো থাকলেই খেলার অনুমোদন মিলবে। এক রাজ্যে রেজিস্ট্রেশন করে অন্য রাজ্যে খেলতে গেলে সেই রাজ্যের সংস্থার থেকে বিশেষ অনুমতিও নিতে হয় খেলোয়াড়দের। অভিযোগ, গ্রামেগঞ্জের খেলায় বিদেশিদের ‘দাপাদাপি’ রুখতে কঠোর নিয়ম প্রণয়ন করা হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
অভিযোগ, বিদেশিদের ডেকে এনে ‘খেপ’ খেলাতে গিয়ে স্থানীয় ফুটবলারের প্রতিভা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। ইসলামপুরের ফুটবল প্রশিক্ষক অমরেশ চাকী বলেন, ‘‘লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে বিদেশি ফুটবলারদের নিয়ে আসা হচ্ছে। কত জনের রেজিস্ট্রেশন আছে? এখানকার ছেলেদের নিয়ে কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই! এ ভাবে চলতে পারে না।’’
বিদেশি ফুটবলারদের সঙ্গে চুক্তিতে কালো টাকারও হাতবদল হয়ে থাকে বলে কারও কারও অভিযোগ রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে জেলার অন্যতম বড় ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজক হাবিব আনসারি বলেন, ‘‘এখানকার দর্শকদের একটাই চাহিদা— বিদেশি ফুটবলার। বিদেশিরা না থাকলে মাঠ ভরছে না। তবে কী নিয়ম রয়েছে, আমরা খুব একটা জানি না। ভাল করে দেখে নিয়ে ভবিষ্যতে বিদেশি খেলোয়াড়দের আনার ব্যাপারে আরও সতর্ক হব।’’