সকালেই উধাও ফল-মিষ্টি-পনির

সীমান্ত পেরিয়ে গুরু পূর্ণিমায় ভিড় নবদ্বীপে

বারো মাসে তেরো পার্বণ নিয়েই বাঁচে চৈতন্যধাম। রাস, দোল, রথযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, শিবের বিয়ের মতো নানা উৎসবকে ঘিরে দেশ-বিদেশের মানুষের নিত্য আনাগোনা নবদ্বীপের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। সেই তালিকায় ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে গুরু পূর্ণিমা। তবে গত কয়েক বছরে নবদ্বীপ তো বটেই পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদেও তা বিরাট এক উৎসবের চেহারা নিয়েছে।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

নবদ্বীপ ও বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৭ ১৪:০০
Share:

গুরু-দুয়ারে: পুজো দিতে নেমেছে ভক্তদের ঢল। নিজস্ব চিত্র

তিন কেজি আমের দাম শুনে শনিবার রাতে চমকে উঠছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুজিত দে। ল্যাংড়ার দাম বাবদ ২৭০ টাকা নিয়ে দোকানদার অম্লান বদনে জানিয়ে দিয়েছিলেন, “আজ তবু টাকা দিয়ে জিনিস পেলেন। কাল গুরুপূর্ণিমা, সকালে দ্বিগুণ দাম দিলেও জিনিস মিলবে না।”

Advertisement

নবদ্বীপ বড়বাজারের ফল বিক্রেতার সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল রবিবার সকালে। সকাল দশটা বাজতেই আম, কলা, আপেল, শশা পেয়ারা থেকে শুরু করে ছানা, পনির বাজার থেকে উধাও। বিলকুল ফাঁকা মিষ্টির দোকানের শো-কেস। সব্জির দরও অন্য দিনের তুলনায় বেশ চড়া। তবে দামে এ দিন সবাইকে টেক্কা দিয়েছে ফুল। পাশাপাশি শাড়ি, ধুতি বা চাদরের কেনাবেচাও ছিল চোখে পড়ার মতো।

বারো মাসে তেরো পার্বণ নিয়েই বাঁচে চৈতন্যধাম। রাস, দোল, রথযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, শিবের বিয়ের মতো নানা উৎসবকে ঘিরে দেশ-বিদেশের মানুষের নিত্য আনাগোনা নবদ্বীপের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। সেই তালিকায় ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে গুরু পূর্ণিমা। তবে গত কয়েক বছরে নবদ্বীপ তো বটেই পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদেও তা বিরাট এক উৎসবের চেহারা নিয়েছে।

Advertisement

নবদ্বীপে দেড়শোরও বেশি মঠ-মন্দির-গুরুবাড়িতে ক্রমশ জমজমাট হয়ে ওঠা গুরু পূর্ণিমা উৎসব শহরের চতুর্দশ পার্বণ হিসাবে গুরুত্ব পাচ্ছে ব্যবসায়ী মহলের কাছেও। রথ ও দুর্গা পুজোর মাঝের এই সময়টা ‘অফ সিজন’ বলেই জানতেন ব্যবসায়ীরা।

কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেই ছবিটা বদলে গিয়েছে। তাই গুরু পূর্ণিমার মতো উৎসবও ব্যাপকতর চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে প্রতি বছর। নিট ফল, দোকানে দোকানে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। শনিবার বিকেল থেকেই দু’-তিন টাকার গাঁদা ফুলের মালা বিকিয়েছে বারো থেকে পনেরো টাকায়। রজনীগন্ধা বা গোলাপের দর বিয়ের মরসুমকে টেক্কা দিয়েছে। ছোট রজনীগন্ধার মালা দশ টাকা থেকে শুরু। প্রমাণ সাইজের মালা বিক্রি হয়েছে একশো থেকে দেড়শো টাকায়। রবিবার বেলা বাড়তেই নবদ্বীপের বাজারের হাল যেন বন্ধের দার্জিলিং। বাজার জুড়ে ফুল ফল মিষ্টি কিছুই নেই।

ফল, সব্জির পাইকার রথীন্দ্র সাহা বলছেন, “নবদ্বীপে অনেক বছর ধরে ব্যবসা করছি। কিন্তু গুরু পূর্ণিমাও যে এত বড় একটা উৎসব হয়ে উঠবে তা ভাবিনি কোনও দিন।” বেলডাঙার মিষ্টি ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল বলছেন, ‘‘গত কয়েক বছর ধরে গুরু পূর্ণিমার আগের দিন থেকে বেচাকেনা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়। সেটা মাথায় রেখেই এ বারে প্রস্তুত ছিলাম। এবং দিনের শেষে ভালই বিক্রি হয়েছে।’’

এ যদি বাজারের ছবি হয় তাহলে গুরু বাড়ির দৃশ্য আরও চমকে দেবে। গুরু পূর্ণিমার সকালে গুরুকে প্রণাম করবেন বলে কেউ মাঝরাতে ভেসেলে পার হয়েছেন আষাঢ়ের পদ্মা। কেউ আবার ছেলের অস্ত্রোপচারের বাহাত্তর ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ধরেছেন বিমান। চোদ্দো বছর আগে দীক্ষা নেওয়ার পরে এই প্রথম গুরু প্রণাম করতে এলেন বাংলাদেশের চাঁদপুরের ব্যাঙ্ক কর্মী সঞ্জয় চক্রবর্তী। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের পদস্থ কর্ত্রী রীতা পাল এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। খুলনার সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চম বর্ষের পড়ুয়া সত্যজিৎ বণিক।

শনিবার বিকেলে থেকেই একটা করে লোকাল ট্রেন থেমেছে আর নবদ্বীপ কিংবা বিষ্ণুপ্রিয়া হল্টে বেড়েছে ভিড়। রবিবারে সে ভিড় আরও বেড়ে যায়। ভোর থেকেই শহরের সব মন্দিরের সামনে লম্বা লাইন। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাসের কথায়, “বছর কয়েক ধরে গুরুপূর্ণিমা উৎসবে কী পরিমাণ লোক আসছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। বাণিজ্যিক দিক থেকে এটা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।”

রবিবার দিনভর গুরু পূর্ণিমার উৎসবের ছোঁয়া লেগেছিল মুর্শিদাবাদেও। বেলডাঙা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গুরু পূর্ণিমা বিষয়ে আলোচনা করেন অধ্যক্ষ স্বামী প্রদীপ্তানন্দ মহারাজ। সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশনে এ দিন পুজোপাঠ, আরতি ও ভক্তিমূলক সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন