•নিত্যকার: ট্রাক্টর আর ধুলো নিয়ে পড়ে আছে মাঙ্গনপাড়া। নিজস্ব চিত্র
সকালে উঠে পড়তে বসা। তারপর স্নান, খাওয়াদাওয়া সেরে স্কুলে যাওয়া। এতদিন এটাই ছিল রেজিনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির রুম্পা মণ্ডলের রুটিন। গত কয়েক মাস থেকে সেই রুটিন বদলে গিয়েছে। এখন সাতসকালে উঠেই সে স্নান সেরে নিচ্ছে। তারপর পড়াশোনা শেষ হলে খেয়েদেয়ে স্কুলে যাচ্ছে সে।
রুম্পা মায়েরও রান্নার সময়ও এখন বদলে গিয়েছে। আগে একটু বেলা করেই রান্নাঘরে ঢুকতেন তিনি। এখন রান্না সেরে নিতে হচ্ছে ভোরবেলায়। কারণ, রাস্তার পাশেই রান্নাঘর। ফলে ধুলোঝড় উঠলেই রান্নার দফারফা হয়। রুম্পার মা কল্পনা মণ্ডল বলছেন, ‘‘কষ্ট তো হচ্ছেই। কিন্তু কী করব বলুন? যাঁদের করার কথা, তাঁরাই তো সব চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। অগত্যা নিজেদের জীবনযাপনে বদল আনতে হচ্ছে।’’
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেও রেহাই নেই। রুম্পা আর আগের মতো বাড়ির সামনে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারে না। কারণ, সেই সময়েও মাটিবোঝাই ট্রাক্টরের সারি ধুলো উড়িয়ে গ্রামের পথ দিয়ে যাতায়াত করে। রুম্পার প্রশ্ন, ‘‘আমরা আবার কবে আগের মতো খেলতে পারব?’’
রেজিনগরের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে পশ্চিম দিকে দেড়-দু’কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই মাঙ্গনপাড়া। শীত ও গ্রীষ্মকাল জুড়ে এই গ্রাম আতঙ্কে থাকে। গ্রামের লোকজন জানাচ্ছেন, এই মরসুমেই ইটভাটাগুলো রমরমিয়ে চলে। আর সেই ভাটাগুলোতে মাটির জোগান দিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে অবিরাম যাতায়াত করে ৬০-৭০টি মাটিবোঝাই ট্রাক্টর।
গ্রামের অর্জুন মণ্ডল, কার্তিক মণ্ডল, বিকাশ মণ্ডলেরা সমস্বরে জানাচ্ছেন, বেপরোয়া ভাবে ট্রাক্টরের যাতায়াতের কারণে বেশ কয়েক বার দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার থেকেও বড় কথা, ধুলোর কারণে লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে বহু বার এ সমস্যার কথা লিখিত ভাবে জানিয়েও কোনও ফল মেলেনি।
প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে বছর কয়েক আগে হেঁশেল ছেড়ে রাস্তায় নেমেছিলেন মাঙ্গনপাড়ার মহিলারা। তাঁরা আটকে রাখেন মাটিবোঝাই খান দশেক ট্রাক্টর। খবর পেয়ে প্রশাসনের কর্তারা ছুটে এসে কোনও রকমে পরিস্থিতি সামাল দেন। তারপর বেশ কিছু দিন সে রাস্তায় ধুলোঝড় বন্ধ ছিল। পরের দিকে ট্রাক্টরের চালকেরা রাস্তায় জলও ছিটিয়েছিলেন। তারপর ফের মাঙ্গনপাড়া ঢেকে গিয়েছে ধুলোর চাদরে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এখন গাঁ-গঞ্জে অনেকেরই পাখির চোখ মাটি। কেউ জমি কেনাবেচা করছে। কেউ আবার জমি রেখে স্রেফ মাটিটুকু বেচে দিচ্ছে। সে ব্যবসায় লাভও মন্দ নয়। ফলে ইটভাটার পাশাপাশি, নিচু জায়গা উঁচু করা, বাড়ি কিংবা নতুন রাস্তা তৈরির কাজেও মাটির চাহিদাও রয়েছে। আর সেই মাটির জোগান দিচ্ছে এই ট্রাক্টরগুলি। বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘কে কী ভাবে ব্যবসা করবেন সেটা তাঁদের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের এ ভাবে সমস্যায় ফেললে কী করে হবে? রাস্তায় ভাল ভাবে জল ছেটানোর পাশাপাশি প্রশাসন কিছু একটা বিকল্প ব্যবস্থা করুক।’’
গ্রামের যাদব মণ্ডলের কথায়, ‘‘ওই ধুলোর কারণেই বেশ কিছু দিন থেকেই শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জির সমস্যায় ভুগছি।’’ তিনি একা নন, তাঁর মতো অনেকেই ধুলোর কারণে নানা রকম শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন বলেও অভিযোগ মাঙ্গনপাড়ার।
বেলডাঙা ২ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবাশিস সাহা বলছেন, ‘‘ধুলোর কারণে অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতেই পারে। তবে এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে ঠিক কী কারণে সমস্যা হচ্ছে।’’ স্থানীয় রামপাড়া ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের বাহার আলি মল্লিক বলেন, ‘‘এই সমস্যা দীর্ঘ দিনের। ব্লক প্রশাসনকে জানিয়েছি। ভাটার মালিক ও ট্রাক্টর চালকদেরও বলেছি রাস্তায় জল ছেটাতে। কিন্তু সেটা নিয়মিত না করায় সমস্যা হচ্ছে। আমি আবার ওদের সঙ্গে
কথা বলব।’’
বহরমপুরের মহকুমাশাসক দিব্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এমন ঘটনার কথা আমাকে তো কেউ জানায়নি। বিডিও-র সঙ্গে কথা বলে দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করা হবে।’’