পথ আটকে চাঁদা আদায়। কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন প্রান্তে। —নিজস্ব চিত্র।
মসৃণ পিচ রাস্তা। স্পিডব্রেকারও নেই।
অথচ দ্রুত গতিতে ছুটে চলা গাড়িগুলো ম্যাজিকের মতো থেমে যাচ্ছে মাঝ রাস্তায়।
সৌজন্যে জনাকয়েক যুবক। আর তাঁদের হাতে থাকা রংবেরঙের রসিদ। চাঁদার কুপন— দশ, বিশ ও পঞ্চাশ।
রাস্তার পাশে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল, মোটরবাইক। আর গোটাকয়েক চেয়ার।
রাস্তায় গাড়ির চাপ না থাকলে হাহা...হিহি...চা...সিগারেট সেখানেই। মাথায় সানগ্লাস তুলে বছর পঁচিশের এক যুবক বাকিদের বোঝাচ্ছিলেন, ‘‘শোন, রাস্তা কারও বাপের নয়, দাপের। এ বারের বাজেট মনে আছে তো? সে ভাবেই চমকাতে হবে।’’
‘‘বটেই তো! বাজেট তো কম নয়। পাক্কা চার লাখ। পাশের পাড়াকে টেক্কা না দিতে পারলে তো মানও থাকে না।’’ ঘাড় নাড়ছেন অন্যরাও।
আর পুজো উদ্যোক্তাদের সেই মান রাখতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন গাড়ির চালক থেকে যাত্রী সকলেই।
করিমপুর কৃষ্ণনগর রুটের এক বাস চালক বলছিলেন, ‘‘চাঁদার এই জুলুম নতুন নয়। তবে ইদানীং সেই অত্যাচার এতটাই বেড়েছে যে, সহ্য করা মুশকিল। প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে যদি এ ভাবে চাঁদার জুলুম চলতে থাকে তাহলে তো গাড়ি চালানোই মুশকিল।’’
বারো মাসে তেরো পার্বণের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। তার খরচা কে জোগাবে?
উত্তর একটাই, ‘‘কেন, পাবলিক!’’ আর সড়কপথে যে ‘পাবলিক’ বাসে না উঠে দু’চাকা বা চার চাকায় যাতায়াত করেন তাঁর দায় যেন আরও বেশি। দাবি মতো চাঁদা দিতে না চাইলে শুনতে হয়, ‘‘সে কী মশাই! প্রাইভেট গাড়ি চড়ছেন। আর একশো টাকা বের করতে এত আপত্তি?’’ ডোমকলের এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, ‘‘পরবের সময়টা রাস্তায় বেরোতেই ভয় হয়। চাঁদার জন্য এই জুলুমটা সত্যিই নেওয়া যাচ্ছে না।’’
আর মাসকয়েক আগে হাঁসখালিতে চাঁদার জুলুমের ঘটনা সারাজীবন মনে রাখবেন সেই ট্রাক চালক। যিনি দাবি মতো পুজোর চাঁদা না দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। চালকের সেই ‘স্পর্ধা’ সহ্য হয়নি চাঁদা আদায়কারীদের। ‘ধুম’-এর কায়দায় বাইক নিয়ে ধাওয়া করে ট্রাক থামিয়ে চালককে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠেছিল সেই আদায়কারীদের একাংশের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার পরে কিছুদিন নড়েচড়ে বসেছিল পুলিশ। তারপর ফের চাঁদার রাজ্যে উৎসব আরও রঙিন হয়ে উঠেছে। পুলিশের দেখা নেই।
বর্ষার মরসুম থেকেই শুরু হয় পালা-পরব। ইদ, বিশ্বকর্মা, দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, সরস্বতী, মহরম, জগদ্ধাত্রী, রাস—তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। বহরমপুরে চাঁদার জুলুম যেমন সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। ফি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর আগে থেকে সিঁটিয়ে থাকেন গাড়ি চালকেরা। চিন্তায় থাকে শহরও। চাঁদার জুলুম, যানজট, লরি চালককে মারধর এবং অধরা অভিযুক্ত—বহরমপুরের গত কয়েক বছরে চকিতে চাঁদা-চিত্র এমনটাই!
মাসখানেক আগে পঞ্চাননতলা রেলগেটের কাছে মধুপুর-বিষ্ণুপুর রোডে বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য লরি চালকদের কাছে চাঁদা আদায় করছিলেন তৃণমূলের লরি শ্রমিক সংগঠনের লোকজন। তাঁদের দাবি মতো চাঁদা দিতে রাজি হননি দুই লরি চালক। সেই ‘অপরাধে’ ওই দুই চালককে লাঠি, রড ও বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। দুই চালককেই গুরুতর জখম অবস্থায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়েছিল।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চাঁদার জুলুমে ডান-বাম কোনও তরফই পিছিয়ে থাকে না। পুজোর আগে ফি বছরই এমন কাণ্ড ঘটে। আর ভাঙা রেকর্ডের মতো পুলিশ একই কথা বলে চলে। অভিযুক্তেরা কেউ ধরা পড়ে না। তবে গত কয়েক দিনে চাঁদা আদায়ের কৌশলে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
দিনের পরিবর্তে রাতে চাঁদা আদায় শুরু করেছেন বিভিন্ন লরি সংগঠনের সদস্যরা। তাতে যানজট অবশ্য বন্ধ হয়নি। শুধু সময়টা পাল্টে গিয়েছে। গত বছর খোদ কৃষ্ণনগরের চারগেট এলাকায় চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় এক টোটো চালককে মেরে নাক ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বারেও উৎসব মরসুমের আগে উদ্বিগ্ন শহর।
নদিয়া জেলা বাস মালিক সমিতির পক্ষে অসীম দত্ত বলেন, “এই সময়টা সত্যিই ভয়ের। গত বার চাঁদার জন্য বগুলা, বেতাই, বেথুয়াডহরি এলাকায় আমাদের কর্মীরা মার খেয়েছেন। প্রতি বছরই বিষয়টি প্রশাসনকে জানাই। এ বারেও জানাব। তাতে কোনও ফল হবে কি না জানি না।’’
বহরমপুর থানার আইসি শৈলেন বিশ্বাস বলছেন, ‘‘চাঁদার জুলুম রুখতে রাস্তায় পুলিশের টহলদারি রয়েছে। তবে পুজো উদ্যোক্তারা সচেতন না হলে কেউ কিছু করতে পারবে না।’’
নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “চাঁদার জুলুম কোনও ভাবে বরদাস্ত করা হবে না। সেই মতো প্রতিটি থানাকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।’’ আর জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘চাঁদার জুলুমবাজির অভিযোগ পেলেই জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করা হবে। যাঁরা চাঁদা তুলবেন তাঁদের পাশাপাশি ওই ক্লাবের সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষর বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করে গ্রেফতার করা হবে।”
তাহলে চাঁদার চাপ থেকে কি এ বার সত্যিই মুক্তি পাবে দুই জেলা?
উত্তর মিলবে এ মাসেই।