সম্প্রীতির উৎসব পালন করল রাজাপুর

পশ্চিমমুখো হয়ে বসে একমনে আসরের নমাজ পড়ছিলেন প্রবীণ মানুষটি। পাশ দিয়ে খোল-করতাল বাজিয়ে সবে গিয়েছে ইস্কনের রথ। হাজার হাজার মানুষের পায়ে পায়ে রাজাপুরের সুড়কির রাস্তার লাল ধুলো তখনও উড়ছে বাতাসে।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৫ ০০:৫০
Share:

সম্প্রীতির আলিঙ্গন। রাজাপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

পশ্চিমমুখো হয়ে বসে একমনে আসরের নমাজ পড়ছিলেন প্রবীণ মানুষটি। পাশ দিয়ে খোল-করতাল বাজিয়ে সবে গিয়েছে ইস্কনের রথ। হাজার হাজার মানুষের পায়ে পায়ে রাজাপুরের সুড়কির রাস্তার লাল ধুলো তখনও উড়ছে বাতাসে। শোভাযাত্রার পিছনে চলা মানুষের ছেঁড়া ছেঁড়া ভিড় রাস্তায়। দূর থেকে ভেসে আসছে সংকীর্তনের আবছা সুর।

Advertisement

রথযাত্রা এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে আসরের নমাজ। মোনাজাত সেরে পশ্চিম দিক থেকে ঘুরে চলে যাওয়া রথের দিকে মুখ করে প্রবীণ মানুষটি চোখ বুঁজে আপন মনেই বলে ওঠেন, “জগন্নাথ স্বামী নয়নপথগামী ...।” নদিয়ার প্রত্যন্ত রাজাপুর গ্রামটি রথযাত্রার বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কেমন যেন অপার্থিব হয়ে উঠল।

এ ভাবেই প্রতি বছর আষাঢ়ের শেষ বেলায় এক আশ্চর্য রথযাত্রার সাক্ষী থাকে রাজাপুরে উপস্থিত হাজার হাজার দেশ-বিদেশের মানুষ। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি ইস্কনের ঝাঁ চকচকে রথ, রাজকীয় আড়ম্বর, জনপ্রিয় তারকাদের ভিড়, সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার যাত্রাপথের রোমাঞ্চ— সব কিছুকে ছাপিয়ে মায়াপুরের রথযাত্রার সুরটি বাঁধা থাকে সম্প্রীতির তানে। সবে দু’দশক পেরিয়েছে মায়াপুর ইস্কনের রথযাত্রা। কিন্তু এর মধ্যেই রাজ্যের উৎসব মানচিত্রে একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে এই রথ। আর কিছু নয়, ভিন্ন ধর্মের মানুষের সাগ্রহ যোগদানে মায়াপুরের রথযাত্রাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

Advertisement

রাজাপুর, যেখান থেকে ইস্কনের রথের যাত্রা শুরু, সেটি নবদ্বীপের মায়াপুর-বামুনপুকুর ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি মুসলিম-প্রধান গ্রাম। আশপাশের সরডাঙ্গা, গোমাঘর, নতুনগ্রাম সবই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। এ সব গ্রামের খেতমজুর, রাজমিস্ত্রির সংখ্যাই বেশি। রাজাপুরের যে জগন্নাথ মন্দির থেকে রথ বের হয়, সেই মন্দিরের সীমানা প্রাচীরের উল্টো পিঠেই জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা। পাঁচিলের এ পাশে প্রশস্ত নাটমন্দির, অন্য পাশে ছড়ানো উঠোন। বর্ষায় সবুজে সবুজ। এই এলাকার মানুষের কাছে ইদ-মহরমের মতো রথও একটা পালনীয় উৎসব। মায়াপুর ইস্কনের রথের রং থেকে রক্ষণাবেক্ষন, সবই হয় সুন্দর শেখ, সুকুর আলি বা আখতার আলির তত্ত্বাবধানে। শুরু থেকে ওঁরাই প্রতি বছর ইস্কনের রথের দেখভাল করে আসছেন। রথের সংস্কার করতে করতে ওরা সেরে নেন জোহরের নমাজ।

মায়াপুর ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “ইস্কনের এই রথযাত্রা সর্বধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা হানিফ মণ্ডল, কেদার শেখ, নাসির শেখ, মুস্তাফা মণ্ডল বা দুলু শেখের মতো মানুষেরা শ্রমদানের সঙ্গে আর্থিক সহায়তার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছেন। ওঁদের ছাড়া মায়াপুর ইস্কনের রথযাত্রা অসম্পূর্ণ।”

ফকির শেখ, মুকশেদ আলি, সুন্দর শেখেরা জানান, প্রতি বছর রথের দিন ওঁরা চেষ্টা করেন কাজে না যেতে। নিতান্তই যেতে হলে আধবেলা করেই চলে আসেন। রথের দড়ি যে টানতেই হবে ওঁদের। নবদ্বীপ বকুলতলা হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক তথা সোনডাঙার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, “রথযাত্রাকে এই এলাকার মানুষ এখন তাঁদের নিজস্ব উৎসব বলে মনে করে যোগ দেন।”

এ বারে ইদ আর রথযাত্রা একই দিনে পড়েছে। আর সেই কারণেই ইদ উপলক্ষে রাজাপুরে সাজানো গেট বিকেলে রথ বের হওয়ার আগেই খুলে দেওয়া হয়েছে। একই ভাবে ইস্কনের তরফে এ বার রথের উদ্বোধনে আনা হয়নি ছোট বা বড় পর্দার কোনও চেনা মুখ। শনিবার কিছুটা ব্যতিক্রমী ভাবেই রাজাপুরে দড়ি টেনে রথযাত্রার সূচনা করেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রতনলাল হাংলু।

এ দিন অবশ্য সম্প্রতির টানে মায়াপুর ইস্কনের রথের চাকা গড়াতে শুরু করে দিয়েছে সকাল থেকেই। শনিবার বেলা তখন ঠিক এগারোটা। রাজাপুরের ইদ্গাহে নমাজের পর্ব শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। চলছে একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। ইদ মুবারক। জগন্নাথ মন্দিরের লাগোয়া মাদ্রাসা বা মাঠ জুড়ে সুর্মা-আতরের গন্ধ ম ম করছে। একই সঙ্গে ওই মাঠের অন্য প্রান্তে ইস্কনের তিনটি রথকে ঘিরে চূড়ান্ত পর্বের ব্যস্ততা। যাত্রা শুরুর আগে শেষ বারের মতো চোখ বুলিয়ে নেওয়া। কিছু বাদ থেকে গেল না তো?

এই সময় হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে জগন্নাথ মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন মায়াপুর ইস্কনের অলয় গোবিন্দ দাস এবং তাঁর সঙ্গে আরও জনা কয়েক বৈষ্ণব ভক্ত। মুখে জয় জগন্নাথ। তাঁরা সটান চলে গেলেন পাশের জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে তখন জমজমাট ভিড়। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা নবদ্বীপের বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা। চলছে শুভেচ্ছা বিনিময়। মাদ্রাসার মুফতি মহম্মদ আশরাফ মণ্ডল সকলকে হাসি মুখে আপ্যায়ন করছেন। নজরে পড়ল মাদ্রাসার গেট দিয়ে আসছেন ইস্কনের জনাকয়েক ভক্ত। তিনি ছুটে আসতেই তাঁকে হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন অলয় গোবিন্দ দাস। ইদের শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতে তুলে দিলেন ফুলের তোড়া। মাদ্রাসার অন্যান্যরা ততক্ষণে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন বাকি ভক্তদের। জানিয়েছেন ইদ মুবারক। রথযাত্রার জন্য সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আশরাফ মণ্ডল তুলে দিলেন পেল্লাই এক রঙিন বাক্স। তার উপরে জ্বলজ্বল করছে ‘ইদ মুবারক।’

দুর্ঘটনায় মৃত্যু। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল ইমরান শেখ (২৭) ও মিন্টু শেখ (২৬) নামে দুই যুবকের। তাঁদের বাড়ি নবদ্বীপ এলাকার আনন্দবাসে। শনিবার বিকেলে ঘটনাটি ঘটেছে ভালুকা বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই দুই যুবক মোটরবাইকে আনন্দবাস থেকে ভালুকার দিকে আসছিলেন। সেইসময় উল্টো দিক থেকে আসা একটি গাড়ি তাঁদের ধাক্কা মারে। ঘটনাস্থলেই দু’জন মারা যান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন