গাছে গাছে ছেয়ে রয়েছে আম। এন্তার আম বোঝাই ডালা নজরে পড়ছে বাজারে। তাতে আমজনতার পৌষ মাস। কিন্তু কপালে ভাঁজ চাষি আর বাগান জমা নেওয়া ব্যবসায়ীদের। কারণ, ভাল ফলনের দৌলতে বাজারে আমের দাম পাচ্ছেন না বলে দাবি তাঁদের। মুর্শিদাবাদ, মালদহ থেকে হুগলি— ছবিটা প্রায় সর্বত্রই এক।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই যে বছর আমগাছে প্রচুর মুকুল আসে, তার পরের বছর অর্দ্ধেক মুকুলও ধরে না। তবে প্রচুর মুকুল এলেই হবে না, ভাল ফলনের জন্য আবহাওয়া অনুকূল হওয়া চাই। অর্থাৎ, কুয়াশা কম হতে হবে। ঝড়ঝাপটা কম হতে হবে। ঠিকমতো বৃষ্টি হতে হবে। ভাল ফলনের জন্য আবশ্যক এ সব শর্ত এ বছর পুরোপুরি পূরণ হওয়ায় আমের ফলন ভাল হয়েছে।
উদ্যানপালন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর মুর্শিদাবাদ জেলায় ২৩ হাজার হেক্টরে ৩৫ হাজার টন আম ফলেছিল। এ বছর প্রায় একই পরিমাণ জমিতে ফলেছে প্রায় ৯৫ হাজার টন। মালদহে গত বার ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার টন আম হয়েছিল। এ বার ৩০ হাজার হেক্টরে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টনের ফলন হয়েছে। হুগলিতে প্রায় ৯৩০ হেক্টর জমিতে গত বার প্রায় ৩,২০০ টন আম ফলেছিল। এ বার সমপরিমাণ জমিতে প্রায় ৬,০০০ টন ফলন হয়েছে।
মুর্শিদাবাদ জেলা উদ্যানপালন বিভাগের উপ-অধিকর্তা গৌতম রায় বলেন, ‘‘এ বারের এই ভাল ফলন কেবল মুর্শিদাবাদ বা রাজ্যেই নয়। গোটা দেশ জুড়েই এ বার আমের ফলন খুব ভাল হয়েছে। ফলে, অন্য বছরের মতো অন্য রাজ্যে এ রাজ্যের আমের তেমন চাহিদা সৃষ্টি হয়নি।’’ চাহিদা না থাকার প্রভাব পড়ছে দামে। ‘মুর্শিদাবাদ জেলা মডেল নার্সারি ও ম্যাঙ্গো গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক হায়াতুন নবির কথায়, ‘‘গত বছর বছর ফলন কম থাকায় জামাইষষ্ঠীর দিন আম বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা কেজি দরে। অন্য সময় বিক্রি হয়েছে ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে। এ বার একই সময়ে বাজারে আম বিক্রি হয়েছে ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা কেজি দরে।’’
ছবি বদলাচ্ছে না মালদহেও। ‘মালদহ ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সহ-সভাপতি উজ্জ্বল সাহার দাবি, গত বছর হিমসাগর আম পাল্লাপিছু (পাঁচ কেজি) ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ বার তা নেমে এসেছে ৪৫-৫৫ টাকায়। সব থেকে কম দামি আম লক্ষ্মণভোগের পাল্লাপিছু দর গত বার ছিল ৪০ টাকা। এ বার তা দাঁড়িয়েছে ২৫-৩০ টাকায়।
সিঙ্গুরের হাকিমপুরের আমচাষি অলোককুমার মাঝি নাঁদা হাটতলায় জেলার অন্যতম আমের হাটে এসেছিলেন আম বেচতে। জানালেন, দর পেয়েছেন পাল্লাপিছু ৫০-৬০ টাকা। মাঝেমাঝে ওই হাটেই সে দর পাল্লাপিছু ৪০-৪৫ টাকায় নামছে। অলোকবাবুর বক্তব্য, ‘‘গত বছর এক পাল্লা হিমসাগর ১৩০ টাকার নিচে নামেনি। এ বার আম বেচে লাভ করা তো দূর, চাষের খরচই উঠছে না।’’
কিছু ব্যবসায়ী রয়েছেন যাঁরা মালিকের কাছ থেকে দুই বা চার বছরের জন্য বাগান ‘লিজ’-এ নেন। লিজের মেয়াদ পর্যন্ত তাঁরাই বাগানের পরিচর্যা থেকে শুরু করে, আম বাজারজাত করা পর্যন্ত সব কিছুর দায়িত্বে থাকেন। ভগবানগোলার রসিক মোল্লা তেমনই এক জন। তাঁরও অভিজ্ঞতা, ‘‘অত্যধিক ফলনের জন্য আশানুরূপ লাভ হয়নি।’’ মগরার ঐশ্বরবাগের এক বাগান-মালিক আবার পড়েছেন অন্য অস্বস্তিতে।
তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমের দাম নেই। বাগান যাঁকে লিজ দিয়েছি, তাঁর থেকে টাকাও চাইতে পারছি না।’’ এমনকী, খুচরো ফল বিক্রেতাদের একটা বড় অংশও দাবি করেছেন, ‘‘অন্য বছরে এক কেজি আম বিক্রি করে যে লাভ হয়েছে, সেই পরিমাণ লাভ করতে এ বার পাঁচ কেজি আম বিক্রি করতে হচ্ছে।’’ ‘মালদহ ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সহ-সভাপতি উজ্জ্বলবাবুর দাবি, ‘‘কর সংক্রান্ত সমস্যার জন্য গত বছর তিনেক বাংলাদেশে আম রফতানি বন্ধ। ফলন কম হলে সমস্যা হতো না। কিন্তু অতি ফলনের মরসুমে রফতানি করতে না পারায় চিন্তা বাড়ছে ব্যবসায়ীদের।’’
তবে ক্রেতাদের পোয়াবারো। সাধারণত দামের কারণে অনেকেই কোহিতুর, হিমসাগর, বিমলি, রঙ্গন, চম্পা, রানিপসন্দ, সড়াঙ্গা, বিড়া, চন্দনখোসা, ল্যাঙড়ার মতো আমের দিকে ফিরেও তাকান না। এ বার অনেক বাজারেই ২০ টাকা কেজির আশেপাশে রয়েছে অনেক ‘জাত’ আমের দর। বাজারে আম রয়েওছে অনেক দিন ধরে। এই পরিস্থিতিতে আমের বাজার বাড়ানোর কথা মাথায় রেখে গত ১২-১৪ জুন কলকাতার আলিপুরে ‘এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে আম-উৎসব। সংস্থার যুগ্ম সচিব এস এল রহমান বলেন, ‘‘সম্মিলিত ভাবে রাজ্য ও কেন্দ্রের মোট পাঁচটি দফতর থেকে আম-উৎসব করা হয়েছে।’’