এ পারে জল, ও পারে জল। মাঝের চরে গরিবের তাজমহল গড়েছিলেন আমলারা।
যাঁরা ওই জলমাটির মানুষ, আষাঢ় ঘনালেই যাঁরা পদ্মা জেগে ওঠার প্রহর গোনা শুরু করেন, তাঁরা পইপই করে বারণ করেছিলেন— ‘‘ওই নাবাল জমিতে ঘর বাঁধেন না কত্তা, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব।’’
মুখ্যু গেঁয়ো লোকগুলোর কথায় আমলই দেননি শহর থেকে বড়-বড় পাশ দিয়ে আসা বাবুরা। কোটি টাকার বেশি খরচ করে জলঙ্গির পরাশপুর চরে ১৯৩টি বাড়ি তৈরি হয়েছিল। রাজ্য সরকারের ‘নিজভূমি নিজগৃহ’ প্রকল্পে ২০১২-১৩ সালে গড়া সে সব বাড়ি স্রেফ ভেসে গিয়েছে। জলঙ্গি পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সভাপতি সাইফুল মোল্লা বলেন, ‘‘চরে যেতে গিয়ে দেখেছি, বাড়িগুলোর মাথা একটু-একটু দেখা যাচ্ছে।’’ এখন ওই সব বাড়ির চিহ্ন পাওয়া কঠিন। দু’একটা ভাঙা ঘর ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভাঙা ইট বালির তলায় চলে গিয়েছে। দরজা-জানালা, ছাউনির টিন ভেঙে ভেসে গিয়েছে। জলঙ্গি পঞ্চায়েত সমিতির কর্তাদের দাবি, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই তাঁরা বারবার বলেছিলেন, নিচু এলাকায় যাতে বাড়ি তৈরি করা না হয়। কিন্তু নতুন তৃণমূল সরকারের আমলারা তাঁদের কথায় আমল না দিয়ে উল্টোটা করতেই ব্যস্ত ছিলেন।
এই গুচ্ছ নির্মাণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল রাস্তার ঘারের ঝুপড়িবাসীদের পাকা ঘরে ঠাঁই দেওয়া। কিন্তু কেউই প্রায় ঝুপড়ি ছেড়ে ওই চরের ঘরে যেতে রাজি হননি। বর্ষাকালে ফের ঠাঁইহারা যে হতে হবে, তা বুঝেই পিছু হটেছেন তাঁরা। স্থানীয় ঘোষপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য তথা পরাশপুর চরের বাসিন্দা জাবদুল মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা প্রশাসনের কর্তাদের হাতে-পায়ে ধরে বলেছিলাম, আমাদের পাট্টা পাওয়া উঁচু জমিতে ঘর দেওয়া হোক। কিন্তু গুচ্ছ নির্মাণের কথা বলে ওঁরা নিচু এলাকায় ঘর বানান।’’ চরের বাসিন্দাদের আক্ষেপ, শুখা মরসুমে এসে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের আমলারা মাপজোক করে ঠিক করে ফেলেন, এখানেই লাইন দিয়ে ঘর হবে। তার এই পরিণতি। ঘোষপাড়া পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রধান শুকচাঁদ মণ্ডল বলেন, ‘‘সে সময়ে আমরা লিখিত ভাবে প্রতিবাদ করি। কোনও ফল হয়নি। প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচে তৈরি এক-একটা বাড়ি! সবই জলে গিয়েছে।’’ একেই বোধহয় বলে, ‘সরকারি মাল, দরিয়ায় ঢাল!’ ভূমি দফতরের ব্লক অফিসের বর্তমান কর্তারা পূর্বসূরীদের কাজের দায় নিতে নারাজ। স্রেফ ‘জানি না’ বলে তাঁরা এড়িয়ে গিয়েছেন। জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি, তৃণমূলের শাহনাজ বেগম বলেন, ‘‘ওই সময়ে যাঁরা জেলা পরিষদ বা পঞ্চায়েত সমিতিতে ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরাই বলতে পারবেন, কেন এমন হয়েছিল। তবে আমরা ওই এলাকায় নতুন করে বাড়ি, রাস্তা ও কালভার্ট তৈরির পরিকল্পনা করছি।’’