ছকটা জানা! অঙ্কটা অচেনা নয়। তার পরেও বাৎসরিক বিনয়ে খামতি থাকে না। কখনও বাবাজীবন হেঁ-হেঁ করেন, ‘‘আহা, থাক না, এ সবের আবার কী দরকার ছিল!’’
খরচার খোঁচাটা কি সটান বুকে বিঁধল? জামাইয়ের মুখ-মানচিত্র দেখে পোড়খাওয়া শ্বশুরমশাইয়ের মন বলল এক কথা। কিন্তু মুখে বললেন, ‘‘তাই বললে কী হয় বাবা, বচ্ছরকার দিনে এটুকু তো...!’’
এ পোড়া বঙ্গে রঙ্গের অভাব নেই। উত্তর থেকে দক্ষিণ ষষ্ঠী-চিত্রটা সর্বত্রই কমবেশি এক। তার পরে জামাইষষ্ঠীর দিনভর চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় সাবাড় করে, মেসি-রোনাল্ডো মেরে, আবহাওয়াকে গাল পেড়ে ভেট নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন বাবাজীবনেরা। বুধবার হুগলির তালচিনান থেকে ভদ্রেশ্বর ফিরছিলেন স্বপন ঘোষও। পুত্র-কন্যা তখনও চঞ্চল। স্ত্রীর চোখ ছলছল। স্বপনের মনও উচাটন। কানের ভিতর দিয়ে মরমে ঢুকে বাস্তবে বাজার-খরচা কমাবে তেমন প্রস্তাব তো এখনও এল না!
ঠিক তখনই পিছন থেকে শোনা গেল, ‘‘ও স্বপন, বস্তাটা ভ্যানরিকশায় তুলে দিয়েছি। সাবধানে নিয়ে যেয়ো বাবা।’’ পলকে উধাও গুমোট গরম। চারপাশে যেন অনন্ত বসন্ত। শুধু কোকিলটাই যা ডাকল না। স্বপনও প্রতি বছরের মতো শুনিয়ে দিলেন সেই এক কলারটিউন, ‘‘আহা, এ সবের আবার কী দরকার ছিল!’’
ভ্যানরিকশা থেকে স্টেশন সেই বস্তা বড় আগলে আগলে নিয়ে এসেছেন স্বপন। সারাটা ট্রেনে এক বারের জন্যেও চোখের আড়াল করেননি। বস্তায় আছেটা কী? স্বপন হাসছেন, ‘‘আলু। তবে চন্দ্রমুখী! বাজারে এখন বাইশ থেকে চব্বিশ টাকা কিলো। এক বস্তা মানে পঞ্চাশ কেজি। তার মানে হল গিয়ে ধরুন....।’’
হিসেবি স্বপন ফের পাটিগণিতে ডুব দেন। কেউ নতুন পোশাক দেন, কেউ অন্য কোনও উপহার, নতুন জামাই হলে কেউ আবার ধরিয়ে দেন মধুচন্দ্রিমার টিকিটও। তাই বলে জামাইষষ্ঠীতে আলু? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন স্বপন, ‘‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে? আপনি জানেন, আমার শ্বশুরের কত আলু-আবাদ আছে? গত ষষ্ঠীতে দু’বস্তা চন্দ্রমুখী দিয়েছিলেন। এ বারে ফলন কম। তাই এক বস্তা।’’
বছর দুয়েক আগে মুর্শিদাবাদের এক যুবক বিয়ে করেছেন তেহট্টে। গত বছর ষষ্ঠীতে প্যান্ট-শার্টের পিস দেওয়ার পরে জামাইয়ের মুখের অভিব্যক্তি বড় সুবিধের মনে হয়নি শ্বশুরের। এ বার আর শ্বশুরবাড়ি কোনও ঝুঁকি নেয়নি। ফোন গেল মুর্শিদাবাদে। মেয়ের কাছে জানতে চাওয়া হল, ‘‘হ্যাঁ রে, জামাইয়ের সঙ্গে তুই এক বার কথা বলে নিস। আসলে ওর পছন্দ-অপছন্দ তো বোঝা দায়।’’
রাতের খাবার বাড়তে বাড়তে স্ত্রীও কথাটা তুলেছিলেন। একটু ভেবে ওই যুবক বলেছিলেন, ‘‘বড্ড মশা! গোয়ালে গরুগুলোও খুব কষ্ট পাচ্ছে। বাড়িতে বলে দাও, ও সব প্যান্ট-শার্ট কিনে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। তার থেকে গরুগুলোর জন্য একটা মশারি কিনে দিতে বোলো। অবলা প্রাণীগুলোও বাঁচবে। আমারও খরচাটা বেঁচে যায়।’’
কথা রেখেছেন স্ত্রী। কথা রেখেছে শ্বশুরবাড়িও। বিয়েতে পাওয়া মোটরবাইকে চেপে যুগলে বাড়ি ফিরেছেন বৃহস্পতিবার। বাইকের পিছনে শক্ত করে বাঁধা ছিল ঢাউস একটা মশারি!