জিএসটিতে কুপোকাত হালখাতাও

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে প্রবীণ সংস্কৃতজ্ঞ শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্তের— বছর ষাটেক আগে পয়লা বৈশাখের ভোর মানে গঙ্গায় স্নান।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০১:৫৬
Share:

লালশালু মোড়া লম্বাটে এক খাতা। কয়েক দশক আগেও গোটা বঙ্গদেশে খুচরো বিকিকিনির পাই-পয়সার হিসেব সাদা সুতো দিয়ে বাঁধা থাকত তাতেই।

Advertisement

হালখাতা! সেই খাতাই ধরে ছিল বঙ্গলক্ষ্মীর হাল।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে প্রবীণ সংস্কৃতজ্ঞ শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্তের— বছর ষাটেক আগে পয়লা বৈশাখের ভোর মানে গঙ্গায় স্নান। তার পর হালখাতা নিয়ে পুজোয় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ব্যবসায়ীরা। কেউ পোড়ামা মন্দিরে, কেউ মহাপ্রভু মন্দিরে যেতেন হালখাতা দেবপদে ছুঁইয়ে আনতে। নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে পুরোহিতের পাশে বসতেন দোকানি-বণিকেরা। গণেশ পুজোর শেষে হালখাতায় সিঁদুর মাখানো টাকার ছাপ পড়া মানেই বছর শুরু। প্রযুক্তির ঠেলায় সেই হালখাতাই এখন হাল ছেড়েছে!

Advertisement

এক সময়ে মাঘ থেকে শুরু হত হালখাতা তৈরির কাজ। মরসুম শেষ হত চৈত্রের প্রথম সপ্তাহে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ডজনখানেক কারিগর নিয়ে দিনরাত কাজ করেও ‘অর্ডার’ সামলাতে নাজেহাল হয়ে যেতেন স্নেহাশিস চক্রবর্তী। তাঁর আক্ষেপ, “নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের এক-এক জন দোকানদার তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার খাতা অর্ডার দিতেন। পয়লা চৈত্র থেকে শুরু হত তাঁদের কাছে খাতা পৌঁছনোর পালা।’’ সেই তিনিই ২০১৩ সাল থেকে হালখাতা তৈরি বন্ধ করেছেন। কেন? ‘‘কেনার লোক নেই”— বলেন তিনি।

নতু সহস্রাব্দের গোড়াতেও এতটা বেহাল দশা হয়নি হালখাতার। তার পর যত সময় গড়িয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে কম্পিউটার অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এখন জিএসটি আসার পরে তো আরওই। বহরমপুরের ব্যবসায়ী সৈয়দ টিপু বলেন, ‘‘এক সময় ছিল, যখন হালখাতা মানেই ব্যবসায়ীদের আশা থাকত, পুরনো হিসেবের জের মিটিয়ে নতুন বছরের সূচনা হবে। সব ধার-দেনা মিটিয়ে দেবেন ক্রেতারা।’’ তাই হয়তো বাহারি ফুলে দোকান সাজিয়ে, মিষ্টি-সরবতে খদ্দেরদের আপ্যায়ন করা হত।

উৎসব এখনও হয়, তবে সেটা নিতান্তই নিয়মরক্ষা— বলছিলেন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী চিরঞ্জীব ঘোষ। ওষুধ ব্যবসায়ী অশোক ঠাকুর বলেন, “কেনাবেচা সবই এখন কম্পিউটার-নির্ভর। খামোকা ওই খাতার হ্যাপা কেন পোহাবে ব্যবসাদার?” খাতা ব্যবসায়ী নবদ্বীপের অশোক চক্রবর্তীর হিসেবে, “গত পাঁচ-ছ’বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে দশ থেকে কুড়ি শতাংশ বিক্রি কমছে হালখাতার। এখনও কিছু পুরনো ব্যবসায়ী এবং গ্রামীণ ক্রেতারা আছেন বলে হালখাতার চল রয়েছে। আর দশ বছর পরে আদৌ থাকবে কি না সন্দেহ আছে।”

ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন শপিং, পেটিএমের ধাক্কায় হালখাতার পলেস্তারা খসছিল কয়েক বছর ধরেই। তবে তার শিকড় ধরে নাড়া দিয়ে ভিত কার্যত উপড়ে দিয়েছে জিএসটি। পুরনো বছরের বকেয়া শোধ করার পর একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ, ক্যালেন্ডার বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে হালখাতা উদ্‌যাপনের ঝলমলে ছবিটা ক্রমশ রং হারাচ্ছে। শহরে থেকে দূরে মফস্সল বা গ্রামীণ জনপদে এখনও বছরের প্রথম দিনটা আগের মতোই আসে।

তবে সে আর কত দিন?

(তথ্য: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভাশিস সৈয়দ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement