পুড়ছে দুই জেলা, মন্দা বাজারে

বড় বড় গাছের তলায় জটলা পাকানো কিছু মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। ছেলেদের খালি গা। কাঁধে গামছা। খোলা আকাশের নিচে বিছানো মাদুর বা শীতলপাটি। হাতপাখা কিংবা কাঁধের গামছা নেড়েও যেন শান্তি মিলছে না। বেলা বাড়তেই পান্তাভাত খেয়ে বাড়ি ছেড়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন গাছতলায়। বেড়ার ঘরে নিচু টিনের চালে বৈশাখের দুপুরের অসহনীয় গরমই ওঁদের ঘরছাড়া করেছে।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০০:৫৮
Share:

প্রচণ্ড গরমে সুনসান রাস্তাঘাট।

বড় বড় গাছের তলায় জটলা পাকানো কিছু মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। ছেলেদের খালি গা। কাঁধে গামছা। খোলা আকাশের নিচে বিছানো মাদুর বা শীতলপাটি। হাতপাখা কিংবা কাঁধের গামছা নেড়েও যেন শান্তি মিলছে না। বেলা বাড়তেই পান্তাভাত খেয়ে বাড়ি ছেড়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন গাছতলায়। বেড়ার ঘরে নিচু টিনের চালে বৈশাখের দুপুরের অসহনীয় গরমই ওঁদের ঘরছাড়া করেছে। নদিয়ার করিমপুর, শিকারপুর বা হোগলবেড়িয়া দিকে এমন দৃশ্য এখন প্রতি দুপুরের। সন্ধ্যা নামার আগে কেউ ঘরমুখো হতে চাইছেন না। গরমের প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যেও।

Advertisement

শুরু থেকেই এ বারের আবহাওয়ার মতিগতি ছিল একটু অন্যরকম। একদিকে বৈশাখের নিয়ম মেনে কালবৈশাখি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় সবই হয়েছে। বরং কিছুটা বেনজির ভাবে এক সন্ধ্যায় ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত পর্যন্ত হয়েছে। ১৬ মে সন্ধ্যায় নদিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮২ মিলিমিটার। ওই একদিনই নয়, ১৫ মে বৃষ্টি হয়েছিল ১০ মিলিমিটার, ১১ মে ১৭ মিলিমিটার। তারপরেও দিনভর ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস। বাতাসে আদ্রতার বাড়বাড়ন্তে দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। সারদিন কুলকুল ঘাম। রাতে বিছানার চাদর লেপ্টে থাকছে গায়ের সঙ্গে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই গরম তার স্বমূর্তি ধরেছে। ২২ মে নদিয়ার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১.৭ ডিগ্রি। তারপর থেকে কখনও ৩৮ কখনও ৩৯ আবার কখনও ৪০ এর ঘরে ঘোরাফেরা করেছে তাপমাত্রার পারদ। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, নদিয়ার বাহাদুরপুর, মায়াকোল, চৌগাছা বা হাঁসাডাঙার মতো যে সব অঞ্চল দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা গিয়েছে সেখানে তাপমাত্রা সবসময় আরও ২ ডিগ্রি বেশি। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করছে ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রির মধ্যে। এই সময়ে যা স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে চার ডিগ্রি বেশি। যে কারণে রাতেও গরম কমছে না। আবহাওয়াবিদরা অবশ্য সমুদ্রের তপ্ত গরম হাওয়া বা ‘এল নিনোকে’ এর জন্য দায়ী করছেন। যত নষ্টের গোড়া নাকি সেই-ই। উষ্ণায়ন এবং এল নিনোর যুগলবন্দিতে বিপর্যস্ত মানুষকে স্বস্তি দিতে এখন দু’-এক পশলা নয়, দরকার প্রবল বৃষ্টিপাত।

দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিহীন রুক্ষ আবহাওয়া এবং ক্রমশ বাড়তে থাকা গরমে শুধু চাষআবাদ নয়, থমকে গিয়েছে পর্যটন থেকে পাইকারি ব্যবসা, আমদানি-রফতানি থেকে হাটে-বাজারের খুচরো কেনাবেচা। তীব্র রোদ এবং গরমের জন্য যাবতীয় ব্যবসা বাণিজ্য কার্যত একবেলায় ঠেকেছে। কেনাবেচার এমনই দুরাবস্থা যে বহু দোকানদার জানিয়েছেন, দিনের বেলা তাদের ‘বউনি’ পর্যন্ত হচ্ছে না। কোথাও আবার সামগ্রিক ব্যবসা বানিজ্যের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। নবদ্বীপের বড়বাজার বা কৃষ্ণনগরের বাজার থেকে কান্দির কৃষিবাজার হয়ে বেলডাঙা পাইকারি বাজার— সর্বত্রই ছবিটা একরকম। সকাল নটা বাজলেই যেন অঘোষিত হরতাল। ক্রেতার দেখা মিলছে না। সুনসান রাস্তাঘাট। এগারোটার মধ্যেই শাটার নেমে যাচ্ছে বেশিরভাগ দোকানে। দোকান খুলছে সেই বিকেল সাড়ে পাঁচটা কিংবা ছ’টার পর।

Advertisement

গরমে ক্লান্ত দুই ট্রাফিক পুলিশ।

নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সম্পাদক গোকুলবিহারী সাহা জানান, প্রচণ্ড এই গরমে ব্যবসা বাণিজ্যের সময় পর্যন্ত বিলকুল বদলে গিয়েছে। সকাল সাতটা থেকে দশটার ম ধ্যেই খুচরো পাইকারি সব কেনাবেচা প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারপর খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বেরতে চাইছেন না। ফলে বেলা সাড়ে দশটার মধ্যে দিনের ব্যবসা শেষ। বেলা এগারোটা মানেই যেন হরতাল শুরু হয়ে গেল।

কৃষ্ণনগরের চারপাশের ভান্ডারখোলা, দইয়ের বাজার, বাহাদুরপুর, ধর্মদা, মুড়াগাছা, দিগনগর,শম্ভুনগরের মতো এলাকার ব্যবসায়ীরা যাবতীয় জিনিস পাইকারি কেনেন কৃষ্ণনগরের গোয়ারিবাজার,পাত্রমার্কেট বা বেলেডাঙা বাজার থেকে। তাঁরা জানাচ্ছেন, এখন যা অবস্থা তাতে সকাল দশটার পরে তো ঘর থেকেই বেরনো যাচ্ছে না। ব্যবসা হবে কী করে? একই অবস্থা নবদ্বীপের পাইকারি বড়বাজারেরও। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। রোদে তো কেউ পথেই নামতে চাইছেন না। বৃষ্টি না নামা পর্যন্ত এ মন্দা কাটবে না।”

কান্দিতে অবস্থা এতটাই খারাপ যে বিভিন্ন রুটে বাসের চলাচল সকালের পর থেকেই কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বাস মালিকেরা। বেলডাঙা বাজার থেকে খুচরো এবং পাইকারি জিনিসপত্র কেনাবেচা করেন সংলগ্ন কালীতলা, চৈতন্যপুর ১ এবং ২ নম্বর, বেগুনবাড়ি, কাপাসডাঙার মতো এলাকার ব্যবসায়ীরা। গরমের দাপটে তাঁদের সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। যাঁরা আসছেন তাঁরা কোনও রকমে সকাল আটটা’র মধ্যে কেনাবেচা সেরে পালাতে পারলে বাঁচেন। বেলডাঙা বাজারে ফল এবং সব্জি নিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসে কেনাবেচা করা ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কমেছে চোখে পড়ার মতো।

পর্যটনেও ভাঁটার টান। হোটেল থেকে ধর্মশালা কার্যত ফাঁকা পড়ে আছে। নবদ্বীপ বা মায়াপুর কার্যত পর্যটক শূন্য। হোটেল মালিকদের রাজ্য সংগঠনের সম্পাদক প্রসেনজিৎ সরকার বলেন, “স্কুলে গরমের ছুটি চলছে। তবুও এই তীব্র গরমে লোকে বাড়ি থেকে বেরোতে চাইছেন না। ফলে উইকএন্ড ট্যুরগুলো ভীষন ভাবে মার খাচ্ছে।’’ হাজারদুয়ারি, পলাশিতেও এই একই অবস্থা চলছে।

তবে এই তপ্ত মরসুমে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন বিশেষ এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। যাঁরা গরম মোকাবিলার সামগ্রী বিক্রি করেন। ফ্যান, কুলার, এসি-র চাহিদা তুঙ্গে। বিক্রি বেড়েছে ঠান্ডা পানীয়, ছাতা, রোদচশমা, টুপি বা সুতির জামাকাপড়ের। কৃষ্ণনগরের ব্যবসায়ী প্রদীপ দাস বলেন, “একটা দেড় টনের এসির দাম কমবেশি চল্লিশ হাজার টাকা। সেখানে দশ হাজার টাকায় খুব ভাল মানের কুলার মিলছে। এখন স্ট্যান্ড ফ্যানের চাহিদা সবথেকে বেশি।

বুধবার বহরমপুর এবং কৃষ্ণনগরে গৌতম প্রামাণিক ও সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

(সহ প্রতিবেদন: সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক সাহা ও কল্লোল প্রামাণিক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন