মঙ্গল কামনায়। নির্মলচরে সাফিউল্লা ইসলামের তোলা ছবি।
ইদের সকালে নমাজ শেষ হতেই ‘ওয়ান ডে’।
হাঁটুজল মাথাভাঙা পেরিয়ে ঠোঁটারপাড়া থেকে হুড়মুড় করে দলটা ঢুকে পড়ল কাছারিপাড়ায়। সবার কালো প্যান্ট জোটেনি। তবে জ্যালজ্যালে হলুদ জার্সিতে সবুজ হরফে আদ্যন্ত বাংলায় লেখা ১, ৭, ৯, ১১— সাকিল, ইমরান, ফজল, হাসান। ঠোঁটারপাড়া ব্রাদার্স ইউনিয়ন।
হাবভাব দেখে মাঠের ধারে টানটান দাঁড়িয়ে থাকা কাছারিপাড়া ঈষৎ চুপসে যায়, ‘‘আমাগো কাপটা ঠোঁটারপাড়া পাড়ি দিবা না তো!’
ফুট দশেকের নদীর ওপারে সবুজ হয়ে থাকে কুষ্টিয়া। রোদের রং ঠোঁটারপাড়ার জার্সির মতোই হলুদ।
পরের ইদে আবার অন্য দৃশ্য। খোদ ঠোঁটারপাড়া আবদার করে বসে, ‘‘ইদের দুপুরে ফুটবল। জামালপুরের সঙ্গে। হেরে গেলে মান থাকবে না ভাই। তোরা কিন্তু আসছিস। পুজো নিয়ে ভাবিস না। সবাই মিলে সে কাজ তুলে দেব।’’
কাছারিপাড়াও নিরাশ করত না। ইদের দুপুরে ফুটবল পিটিয়ে, কব্জি ডুবিয়ে বিরিয়ানি খেয়ে বাড়ি ফেরা।
সম্বৎসর, ওদেশের সঙ্গে যে নুন-গোলমরিচ সম্পর্কটা থাকে, ইদের সকালে কিংবা পুজোর বিকেলে সেটুকু উবে যেত পরবের আনন্দে।
আজও সীমান্তের যে কোনও উৎসবে মেতে ওঠেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে ইদ ও পুজোর সময় বড্ড বেশি মনে পড়ে যায় কুষ্টিয়া, মেহেরপুর কিংবা রাজশাহির সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলো।
সীমান্ত ছিল। বিএসএফ ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এত জটিল ছিল না। পড়শি পাড়ার মতো পরবের আনন্দে মেতে উঠত দুই দেশ।
হোগলবেড়িয়ার শঙ্কর মণ্ডল, জলঙ্গির মেহের শেখের স্পষ্ট মনে আছে, ‘‘বিএসএফও বলে দিত, সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে। একই ভাবে সহযোগিতা করত বিডিআর-ও (তখনও বিজিবি হয়নি)। আর ওপার বাংলার মিষ্টি ছাড়া পরবই যেন পূর্ণ হত না!’’
চর ও সীমান্তের গ্রামে এখনও পুজো কিংবা ইদের আলাদা কোনও রং নেই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুজো ও ইদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন রসিদ ও রমাপদ। পুজোর চাঁদা কাটতে কাটতে চোঁয়াপাড়া তরুণ সঙ্ঘের অন্যতম কর্মকর্তা মান্নান শেখ বলছেন, ‘‘শিল্পীকে তাড়া দাও রে, আলোর লোককে ফোন করো রে। এ দিকে মঙ্গলবার ইদ। সেটাও সামাল দিতে হবে। উফ্, নাওয়া খাওয়ার সময় পাচ্ছি না দাদা।’’
জলঙ্গির সুমন সাহা, সীমান্ত সাহা, হোগলবেড়িয়ার আর্জেল শেখ, হাসমত মণ্ডলেরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘ভোরের নমাজে ঘুম ভাঙে। সন্ধ্যার শাঁখ মনে করিয়ে দেয় ঘরের ফেরার কথা। নেই রাজ্যের চর ও সীমান্তে প্রাপ্তি বলতে তো এইটুকুই।’’
সীমান্তের রাঙাচোখ অবশ্য এত কিছু বোঝে না। ইদের বাজার নিয়ে ঘরে ফেরার সময় জলঙ্গির চরের বাসিন্দাদের বার বার বোঝাতে হয়, ‘‘ও স্যার, বিশ্বাস করুন, ব্যাগে নাতির জন্য নতুন পোশাক আছে গো।’’ চর মেঘনাকে বলতে হয়, ‘‘সামনে পুজো তো। তাই চিনি একটু বেশি করেই নিতে হচ্ছে।’’
বাতাসে শীতের আমেজ। হিমে ভেজা ঘাসের উপর টুপটাপ শিউলি। উদাত্ত গলায় মসজিদের মাইকে ভোরের ফজর। বেলা বাড়তেই উঠোনে গড়াগড়ি দেয় শরতের সোনা রোদ। তালপাতার মাদুরে মেদ ঝরায় ভাঁজ ভাঙা সোয়েটার, খয়েরি জামা, নীল প্যান্ট। আর ফেলে আসা ছেলেবেলার অজস্র স্মৃতি।
ওই দূরে, শেখপাড়া পেরিয়ে চরের কাশও মাথা দুলিয়ে অস্ফূটে বলে ওঠে, ‘‘দুগ্গা...দুগ্গা...।’’