ভাগীরথীই যেন সেই ফুরাত নদী

এক দিকে ঢাক বাজিয়ে বিসর্জনের পথে দুর্গা। অন্য দিকে, ‘হায়! হাসান, হায়! হোসেন’ সুরে বুক চাপড়ে মাতম তোলা মিছিল। দুই করুণ দৃশ্যের সাক্ষী থাকল লালবাগ।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও অনল আবেদিন

কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৫৮
Share:

এক দিকে ঢাক বাজিয়ে বিসর্জনের পথে দুর্গা। অন্য দিকে, ‘হায়! হাসান, হায়! হোসেন’ সুরে বুক চাপড়ে মাতম তোলা মিছিল। দুই করুণ দৃশ্যের সাক্ষী থাকল লালবাগ।

Advertisement

সেই নবাবি আমল থেকে লালবাগে মহরম পালন করা হয়ে আসছে। এখন মহরমের ব্যয়ভার গ্রহণ করছে রাজ্য সরকার। মুর্শিদাবাদ এস্টেটের ম্যানেজার সৌরভ মণ্ডল জানান, নবাব পরিবারের বর্তমান বংশধরদের ২৩টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এস্টেটের তহবিল থেকে পালন করা হয়। তার মধ্যে মহরম অন্যতম।

‘মহরম’ আসলে কোনও অনুষ্ঠান নয়। আরবি চান্দ্রমাসের একটি মাসের নাম মহরম। আরব মুলুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে সাম্রাজ্যের আধিপত্য নিয়ে বিবাদের জেরে মহরম মাসের ১০ তারিখে ইরাকের কারবালা ময়দানে হজরত মহম্মদের নাতি হোসেন ও তাঁর পরিবারের মোট ৭২ জনকে হত্যা করে এজিদ বাহিনী। সেই শোকপালনই বর্তমানে ‘মহরম’ নামে পরিচিত। ফুরাত নদী তীরের কারবালার যুদ্ধের অনুকরণে কেউ লাঠিখেলা, বা তরোয়াল চালিয়ে, কেউ মাতমে বুকপিঠ ক্ষতবিক্ষত করে, কেউ খালি হাতে বুক চাপড়ে কারবালার প্রান্তরে মৃতদের
স্মরণ করেন।

Advertisement

বুধবার ভোরে দুলদুল ঘোড়া, ইমাম হোসেনের সমাধির স্মরক হিসাবে তাজিয়া, পতাকা ও যুদ্ধাস্ত্রের নানা প্রতীক-সহ শোকমিছিল বের হয় হাজারদুয়ারি প্যালেসের উত্তর দিকের বিশাল আকারের ইমামবাড়ি থেকে। লালবাগ শহর পরিক্রমা করে সেই সুবিশাল শোকমিছিল পৌঁছয় ৫ কিলোমিটার দূরে ভাগীরথী পাড়ের আমানিগঞ্জ-কারবালা ময়দানে। ফুরাৎ নদীর তীরের ইরাকের কারবালার স্মারক কারবালা তৈরি হয়েছে আমানিগঞ্জে ভাগীরথী পাড়ে। সেই কারবালায় এ দিন মৃতদের উদ্দেশে প্রার্থনা করার পর দুপুরে বাড়ি ফিরে যান। ওই শোক মিছিলে নবাব পরিবারের সদস্যেরা ছাড়াও ছিলেন আপামর হিন্দু-মুসলিম।

মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের এক বংশধর জানান, মহরম শোকের মাস। এই মাসে আনন্দ উৎসব চলে না। সাজগোজ, তেল মাখা চলে না। মাছ খাওয়া যায় না। মহরম মাসের প্রথম তিনদিন সেদ্ধ খাবার খাওয়া হয়। মহরম মাসের ১০ তারিখের আগের রাতে, অর্থাৎ গত মঙ্গলবার রাতে ইমামবাড়িতে আগুনে মাতম অনুষ্ঠিত হয়। ইমামাবাড়ির সহকারি সুপার কামবার আলি জানান, প্রায় ৫০ কুইন্ট্যাল কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হয়। সেই কয়লা দিয়ে তৈরি ১৫ ফুট দীর্ঘ গনগনে আগুনের স্তূপের উপর হেঁটে কারবালার যুদ্ধে মৃতদের সম্মান জানানো হয়। পরদিন বুধবার ভোরে বের হয় শোকমিছিল। শোকমিছিল ফের বের হবে মহরমের ২৫ তারিখ। ৪০ দিন পর হবে ‘চল্লিশা’ ও ৬০ দিন পর হবে ‘ষাটা’।

মহরমকে ঘিরে লালবাগের স্থানীয় বাজারও বেশ চাঙা। মুর্শিদাবাদ (লালবাগ) সিটি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য জানান, মহরমের আগের দু’দিন থেকে মহরমের দিন পর্যন্ত দিন তিনেক ধরে শহরে প্রচুর লোকের জমায়েত হয়। তাই বেচাকেনাও হয়েছে দেদার। মহরমকে ঘিরে মেলা বসে বহরমপুর লাগোয়া পঞ্চাননতলায়, ইসলামপুরের নশিপুরে, ভরতপুরে, সালার ও আরও অনেক এলাকায়। অন্তত ডজন খানেক দল তাদের লাঠি খেলার পসরা নিয়ে হাজির হয়েছে পঞ্চাননতলার কারবালা ময়দানে।

সালারের মহরমে মাটির ঘোড়ার উপর বসানো থাকে রঙিন তাজিয়া। সুদৃশ্য ও সুউচ্চ তাজিয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। শোকযাত্রায় আছে আলোর বাহার ও ব্যঞ্জোর বাজনা। সব মিলিয়ে ২০-২৫টি দলের মধ্যে কোন দল কাকে টেক্কা দিতে পারে তাই নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা।

সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলিমদের অনেকে এই দিনে উপবাস করে থাকেন। কেউ ক্ষীর-খিচুড়ি বিলিয়ে পালন করেন। ইমামাবাড়ির সহকারি সুপার কামবার আলি বলেন, ‘‘বরাবরের মতো এ বারও ৯ মহরম বাদ দিয়ে ৬ মহরম থেকে ১০ মহরম পর্যন্ত ৪ দিন এস্টেট থেকে নবাব পরিবারের বর্তমান ধংশধরদের সবার বাড়িতে ফল, রুটি, ক্ষীর, গুলগুলা, সোয়লি, পায়েসের উপকরণে সাজানো নিয়াজ অর্থাৎ প্রসাদ পাঠানো হয়েছে।’’

মহরমে নদিয়ার কৃষ্ণনগরের হাটখোলাপারা, নলুয়াপাড়া, নতুন গ্রাম, নাজিরাপাড়ায় সুদৃশ্য তাজিয়া-সহ মিছিল বেরোয়। রাজবাড়ির পাশে পীরতলা হয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় এই মিছিল চলে। এ ছাড়াও শান্তিপুরের একাধিক জায়গায় তাজিয়া-সহ শোক মিছিল বেরোয়।

মহরম উপলক্ষে নাকাশিপাড়ার নাগাদি ও বিক্রমপুরে মেলা বসে। পাশাপাশি ধুবুলিয়ার শোনডাঙ্গায় লাঠিখেলা শুরু হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা থেকে রাতভর ২৩টি দলের লাঠিখেলা প্রতিযোগিতা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন