কৃষ্ণনগর পারল। কিন্তু বহরমপুর পারল না।
বেশ কিছু দিন ধরেই ক্ষোভের আঁচ টের পাচ্ছিলেন কৃষ্ণনগরের কাউন্সিলরেরা। নেতাদের একাংশও চাইছিলেন না যে শুধু পুরসভার ‘ক্যারেজ ট্যাক্স’ আদায়ের কারণেই জনমত তাঁদের বিরুদ্ধে চলে যাক।
বৃহস্পতিবার কার্যত সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করেই শহরবাসী ও টোটো চালকদের উপর থেকে ক্যারেজ ট্যাক্সের বোঝা নামিয়ে দিতে বাধ্য হল কৃষ্ণনগর পুরসভা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, প্রাইভেট গাড়ি ও পুরসভার অনুমোদিত টোটো থেকে আর ক্যারেজ নেওয়া হবে না।
২০১৪ সালের মে থেকে শহরের রাস্তায় চলা সমস্ত গাড়ি থেকে টোল ট্যাক্স আদায় করে আসছিল কৃষ্ণনগর পুরসভা। শহরে ঢোকার মুখে ৯টি রাস্তায় টোল বসিয়ে ক্যারেজ ট্যাক্স আদায় করা হত। এই নিয়ে নানা সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় নাগরিকেরা। কাউন্সিলরদের কেউ কেউ আবার টোটো সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত। ফলে অন্য গাড়ির পাশাপাশি টোটো নিয়েও তাঁরা পুরপ্রধানের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
এ দিন সকালেই তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের বাড়িতে পুরপ্রধান অসীম সাহা, দলনেতা অসিত সাহা ও মেম্বর ইন কাউন্সিলের সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অসিত সাহা। আলোচনার পরে ট্যাক্স তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিকেলে কাউন্সিলরদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্তই অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়।
পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহার দাবি, “শহরের মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি মেনেই পুর এলাকায় প্রাইভেট গাড়ির উপর থেকে টোলট্যাক্স তুলে নেওয়া হল। টোটো গাড়ির সংখ্যাও অনেক বেড়ে গিয়েছে। প্রায় ১৪শো টোটো চলে এই শহরে। ফলে টোটো চালকদের আয় অনেক কমে গিয়েছে। তাই টোটোর উপর থেকেও টোলট্যাক্স তুলে নিলাম।” অসিতবাবুর দাবি, “আমি যত দূর জানি, পুরসভা এ ভাবে টোল ট্যাক্স আদায় করতে পারে না।” পুরপ্রধান অবশ্য পাল্টা বলেন, “বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের ৯৩বি ধারা অনুযায়ী সম্পূর্ণ আইন মেনে এই ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছিল।”
কৃষ্ণনগর টোট চালক ইউনিয়নের সম্পাদক তপন কু্ণ্ডু বলেন, “এই সিদ্ধান্তে আমরা খুশি।” কিন্তু খুশি হতে পারছেন না বাস বা ছোট গাড়ির মালিকরা। রাজীবকুমার দে নামে এক ছোট গাড়ির মালিক বলেন, “পুরসভা জুলুম করে আমাদের থেকে ট্যাক্স আদায় করছে। কই নবদ্বীপ পুরসভা তো শহরের গাড়ি থেকে ট্যাক্স নেয় না!” জেলা বাস মালিক সমিতির পক্ষে অসীম সাহা বলেন, “এটা তো অন্যায়। এক রুটের বাস অন্য রুটে গেলেই ট্যাক্স নিচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। লাভ হয় নি।”
কিন্তু কী করে চেনা যাবে কোনটা শহরের বাসিন্দাদের প্রাইভেট গাড়ি? পুরসভার তরফে জানানো হয়, শহরে মাইকে প্রচার করে ফর্ম বিলি করা হবে। যাঁদের গাড়ি আছে তাঁরা ফর্ম ভরে জমা দিলে পুরসভা ‘লোগো’ দেবে। গাড়িতে তা লাগানো থাকলে ট্যাক্স দিতে হবে না।
বহরমপুরে অবশ্য ট্যাক্স নেওয়া চলছেই। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পঞ্চাননতলা মোড় পর্যন্ত বাবুলবোনা রোড নামে পরিচিত ২.২ কিলোমিটার রাস্তা পুরসভার অধীনে রয়েছে। মধুপুর কালীবাড়ির মোড়ের কাছে পুরসভার তরফে টোল আদায় করা হয়। ওই রাস্তা বাবুলবোনা রোড না ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক— তা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা চলছে। ফলে তা সংস্কার ও সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। পুরসভা সূত্রের খবর, ২০০৪-০৫ সালে ওই রাস্তায় টোল আদায় শুরু হয়। পূর্ত দফতর (সড়ক) ২০০৫ সালের ১১ জুলাই ওই রাস্তা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে। তার পরে ৪ অগস্ট রাস্তাটি চওড়া করার কথা ঘোষণা করে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তিও জারি করেন। কিন্তু পুরসভা হাইকোর্টে মামলা করায় বিষয়টি থমকে যায়। মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দারস্থ হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন বলে সমাধামসূত্র বেরোয়নি।
বহরমপুরের পুরপ্রধান তৃণমূলের নীলরতন আঢ্যের দাবি, বহরমপুর পুরসভার খাতায় ওই রাস্তাটির নাম বাবুলবোনা রোড। দাগ-খতিয়ান নম্বর-সহ জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরেও তা পুরসভার নামে রয়েছে। তার মানচিত্রও রয়েছে পুরসভার কাছে। তাই পুরবাসীর যাতায়াতের স্বার্থেই বাবুলবোনা রোড সংস্কারের জন্য পুরসভা টোল আদায় করে।
ওই টোল আদায়ের বিরোধিতা করে এক সময়ে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট লাগাতার আন্দোলন করেছে। বর্তমানে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জাতীয় সড়কে টোলট্যাক্সের নামে তোলাবাজি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এটা অবৈধ এবং অমানবিক। কেননা, মোহনা বাসস্ট্যান্ড থেকে ২০০ মিটার দূরে টোল আদায়ের ফলে ওই রাস্তায় যানজট তীব্র আকার নিয়েছে।’’ তিনি জানান, যেখানে টোল আদায় হয়, তার ৫০ গজের মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়। টোল আদায়ের ফলে ওই রাস্তায় যানজটের ফলে পড়ুয়াদের যাতায়াতে যেমন অসুবিধে হয়, প্রতি মাসে দুর্ঘটনা এবং জীবনহানির ঘটনাও ঘটছে।
সিপিএমের অভিযোগ, গত বার পুরভোটে টোল আদায় বন্ধ করার দাবি তুলেছিল তৃণমূলও। সেই সময়ে কংগ্রেসের দখলে থাকা ওই পুরবোর্ড বর্তমানে তৃণমূলের দখলে। কিন্তু তার পরেও টোল আদায় বন্ধ হচ্ছে না কেন? তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের আশ্বাস, ‘‘টোল আদায় বন্ধ করার বিষয়টি নিয়ে কী করা যায়, দেখছি!’’
জনতা চাপ না বাড়ালে এ সব যে বন্ধ হবে না, তা অবশ্য বলাই বাহুল্য।
হাতে-গরম প্রমাণ কৃষ্ণনগর।