নাম রেখেছি সিলিন্ডার

সিলিন্ডারটা ভাগ্যিস পাওয়া গেল! সেই বিকেলটা চোখ বুজলেই ভাসছে। মহিলা বলছেন, ‘‘বাব্বাঃ, হাতের কাছেই দোকানটায় সিলিন্ডার ছিল বলেই না ছেলেটার মুখ দেখতে পেলাম!’’ ঘটনার বয়স মাস পাঁচেক। প্রসূতি নিয়ে হাসপাতালের পথে আচমকা থমকে গিয়েছিল ছোট্ট অ্যাম্বুল্যন্সটা। গাড়ির চালক নির্বিকার গলায় জানিয়ে ছিলেন ‘গ্যাস শেষ’।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০২:২৪
Share:

রাখঢাকের বালাই নেই। দোকানে রান্নার গ্যাসেই ফুটছে চা। — নিজস্ব চিত্র

সিলিন্ডারটা ভাগ্যিস পাওয়া গেল!

Advertisement

সেই বিকেলটা চোখ বুজলেই ভাসছে। মহিলা বলছেন, ‘‘বাব্বাঃ, হাতের কাছেই দোকানটায় সিলিন্ডার ছিল বলেই না ছেলেটার মুখ দেখতে পেলাম!’’

ঘটনার বয়স মাস পাঁচেক। প্রসূতি নিয়ে হাসপাতালের পথে আচমকা থমকে গিয়েছিল ছোট্ট অ্যাম্বুল্যন্সটা। গাড়ির চালক নির্বিকার গলায় জানিয়ে ছিলেন ‘গ্যাস শেষ’।

Advertisement

তবে ছেলের এলেম আছে, কপালে এতটুকু ভাঁজ না ফেলে রাস্তার পাশে চায়ের দোকান থেকে চটজলদি একটা ব্যবস্থাও করে ফেলেছিল সে। ফুটন্ত কেটলি নামিয়ে রেখে সিলিন্ডারটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন দোকানিও। আর সেই সেই সিলিন্ডারেই হাসপাতালের বাকি পথটুকু দিব্যি পৌঁছে গিয়েছিল সেই অ্যাম্বুল্যান্স।

নির্বিঘ্ন প্রসবের পরে মুচকি হেসে বহরমপুরের সেই মহিলা ছেলের নাম নিয়ে আর দু’বার ভাবেননি। বলছেন, ‘‘ছেলে মাস ছয়েকের হল, বাড়ির সবাই ওকে সিলিন্ডার বলেই ডাকে। মন্দ কী, নামটা আমারও তো বেশ পছন্দের।’’

পছন্দের সেই সিলিন্ডারের আবার একটা সাবেক নাম আছে— ‘ডোমেস্টিক সিলিন্ডার’।

আটপৌরে হেঁশেলের চৌহদ্দির বাইরে যার পা রাখারই কথা নয়, সে এখন ঘরে-বাইরে শেষ কথা। গৃহস্থের রান্নার সিলিন্ডারেই কোথাও ঝোল ফুটছে, কোথাও বা প্রসূতি নিয়ে ছুটছে। বহরমপুরের ওই ঘটনা, তালিকায় নিছক একটা সংযোজন। তামাম মুর্শিদাবাদ জুড়ে ছোট গাড়ি আপাতত ডোমেস্টিক সিলিন্ডারেই বুক বেঁধেছে। পড়শি জেলা নদিয়ার চেহারাটাও প্রায় একইরকম। কৃষ্ণনগর থেকে প্রান্তিক তেহট্ট, সেখানেও হোটেল থেকে অটো, বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার ‘পুলকার’, ভরসা সেই গৃহস্থের রান্না ঘরে—ঝোল,ঝাল,অম্বল, সিলিন্ডারের জবাব নেই! জ্বালানি হিসেবে এটাই দস্তুর।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন রমরমা সত্ত্বেও নির্বিকার সকলেই।

দুই জেলার কর্তারাই বলছেন, দেখভালটাতো পরিবহণ দফতরের। তাদেরই নজর রাখা উচিত।

আর পরিবহণ দফতরের কর্তারা কী বলছেন— মুর্শিদাবাদের আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক চিরন্তন প্রামাণিক বলছেন, ‘‘বহরমপুরে গ্যাস রিফিলিং সেন্টার নেই। কোনও গাড়িতে ‘গ্যাস কিট’ লাইসেন্স দেওয়াই হয় না।’’ তাহলে এত গাড়ি চলে কী করে? আধিকারিক যা বলছেন তা ন্যায়-নীতির কথা— ‘‘ডিজেল-পেট্রলের লাইসেন্স নিয়ে গাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’’

আর নদিয়ার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, ‘‘এমন অভিযোগ পেলেই আমরা অভিযান চালাই। ধরাও পড়ে।’’ গত ছ’মাসে ক’টি অবৈধ গাড়ি ধরেছেন? না, তার উত্তর আর মেলেনি।তবে তিনি ভরসা দিচ্ছেন, দেখুন না আর কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা ফের অভিযান চালু করব।’’

এখন প্রশ্ন, বহরমপুরে রান্নার গ্যাস এমন সহজলভ্য হয়ে উঠল কী করে? বহরমপুরে, ‘ইন্ডেন’, ‘ভারত গ্যাস’ এবং ‘হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম’ বা এইচপি— তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থারও ডিলার রয়েছে। ১৪.২ কেজির সিলিন্ডার বিলিবণ্টন নিয়ে তেমন অসুবিধাও নেই।

ইন্ডেন ডিলার, ‘মুর্শিদাবাদ হোলসেল কনজিউমার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি’র চেয়ারম্যান সুকুমার অধিকারী বলছেন, ‘‘জেলায় আমরা ছাড়া অন্য যে সব সংস্থা থেকে ইন্ডেনের গ্যাস পাওয়া যায়, সেগুলি বেসরকারি। তারা কী করে তা বিলি করছেন বলতে পারব না।’’ নিজেদের এ ব্যাপারে ‘একশো ভাগ স্বচ্ছ’ বলে দাবি করেন তিনি। বেআইনি ব্যবহারের একটা সূত্র অবশ্য ধরিয়ে দিচ্ছেন—‘‘ভ্যানচালকদের একাংশ অনেক সময়ে খোলা বাজারে সিলিন্ডার বিক্রি করে থাকেন বলে শুনেছি। গাড়ির জ্বালানি হিসেবেও যা ব্যবহার হতেই পারে।’’ এইচপি-র বহরমপুরের ডিলার এ ব্যাপারে আরও অকপট। সংস্থার এক কর্তা আঙুল তুলেছেন ভ্যানচালকদের দিকেই। জানাচ্ছেন, তারা অনেক সময়েই রান্নার গ্যাস চড়া দামে খোলা বাজারে বিক্রি করছেন। গুদাম থেকেও সিলিন্ডার বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘না হলে শহর জুড়ে গ্যাস-নির্ভর গাড়ির রমরমা কী করে?’’

শহর-জুড়ে রান্নাঘরে অবশ্য গ্যাসের হাহাকার। গোরাবাজার থেকে ইন্দ্রপ্রস্ত, সর্বত্র গৃহস্থের হা-হুতাশ। সেই ছবিটা উধাও শহরের রেঁস্তোরা, মিষ্টির দোকানে। নিয়মানুযায়ী রেঁস্তোরা কিংবা দোকানে বাণিজ্যিক সিলিন্ডার ব্যবহারের কথা। অভিযোগ, অধিকাংশের রান্নাঘরে চলছে ডোমেস্টিক সিলিন্ডার। এ ব্যাপারে পুলিশ কিংবা জেলা প্রশাসন দেখিয়ে দিচ্ছে পরিবহণ দফতরকে। আর যা শুনে স্থানীয় এক পুল কার চালক হেসে জানাচ্ছেন, ‘‘ও সব আমাদের ‘ফিট’ করা আছে!’’ এক পুলিশ কর্তা জানাচ্ছেন, পরিবহণ দফতর অবশ্য অভিযান চালালেই হাতেনাতে গাড়ি ধরতে পারে। পরিবহণ আধিকারিক— ‘‘ব্যাপারটা আমাদের নজরে রয়েছে ঠিকই। তবে সাকুল্যে জনা চারেক ইন্সপেক্টর, কে তল্লাশি করবে?’’

(তথ্য সহায়তা— কৌশিক সাহা, শুভাশিস সৈয়দ ও সুস্মিত হালদার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন