ফরাক্কা সেতু।—ফাইল চিত্র।
বর্ষায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে গঙ্গা। আর তাতেই আশঙ্কা বাড়ছে ফরাক্কা ব্যারাজের দুর্বল গেটগুলি নিয়ে। গত মার্চ-এপ্রিলে ফরাক্কা ব্যারাজে গঙ্গার খাতে জলের প্রবাহ ছিল মাত্র ৫৫ হাজার কিউসেক। গত কয়েক দিন ধরে অবিরাম বর্ষণে ব্যারাজের সেই জলপ্রবাহ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। জলের এই চাপ বৃদ্ধিতেই ফরাক্কার গেটগুলি নিয়ে আশঙ্কা বেড়েছে ফরাক্কা ব্যারাজের বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের। চাপ সামাল দিয়ে গেট বাঁচাতে এই মুহূর্তে খুলে দেওয়া হয়েছে মূল ব্যারাজের বেশ কিছু গেট। বাকি বন্ধ গেটগুলির দু’পাশ দিয়েও জল বেরিয়ে যাচ্ছে।
১৮.৩০ মিটার উচ্চতার এক একটি গেট দিয়ে প্রতি ফুটে ৫০০ কিউসেক জল প্রবাহিত হওয়ার কথা। বর্তমানে ব্যারাজের বেশ কিছু গেট কার্যত অকেজো। সব থেকে সমস্যা হচ্ছে ওই অকেজো গেটগুলো নিয়ে। কী সমস্যা? ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ জানান, একসঙ্গে এতগুলো গেট অকেজো থাকার ফলে বাকি গেটগুলোর উপর জলের চাপ বাড়ছে। ফলে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আড়াই বছর আগে ফরাক্কা ব্যারাজের একাধিক গেট ভেঙে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় জলসম্পদমন্ত্রী। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ব্যারাজের গেটগুলোর কোনও পরিবর্তন হয়নি।
ফরাক্কার কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হকের আশঙ্কা, “ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ব্যারাজের লকগেটগুলির অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। বর্ষায় জলের চাপে যে কোনও মুহূর্তে বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে রাজ্য।” সুতির বিধায়ক তৃণমূলের ইমানি বিশ্বাস ইতিমধ্যেই ব্যারাজের বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে রাজ্যের সেচমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। ইমানি বলেন, “ভরা বর্ষায় জলের চাপ বাড়ছে ব্যারাজে। সব গেট খুলে দিয়ে জলের বাড়তি চাপ কমানোও সম্ভব নয়। কারণ অর্ধেকের উপর গেট এখন ঠিকমতো খোলাই যায় না। এই অবস্থায় ব্যারাজ বিপন্ন হলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে সবাইকে।”
ফরাক্কা ব্যারাজ সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ১৬০ কোটি টাকা খরচ করে ফরাক্কায় গঙ্গার উপর ২২৪৫ মিটার দীর্ঘ এই ব্যারাজটি চালু করা হয়। মূল ব্যারাজে ১১২টি লক গেট বসিয়ে জল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দীর্ঘ ৪০ বছর পেরিয়েও ব্যারাজের এই গেটগুলি সংস্কার না হওয়ার ফলে ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত আট বার গেট ভাঙার ঘটনা ঘটেছে।
২০১৩ সালের ক্যাগের (সিএজি) অডিট পর্যবেক্ষণের সময় ধরা পড়ে রক্ষণাবেক্ষণ তো দূরের কথা, গেটগুলি ঠিকমতো রং-ও করা হয়নি। ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সংস্থার (ক্যাগ) সমীক্ষাতেও দেখা যায়, প্রায় চার দশক ধরে ব্যবহারের ফলে গেটগুলি পুরোপুরি ভগ্নদশায় এসে ঠেকেছে। ব্যারাজের হেড রেগুলেটরগুলিও এতটাই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে যে তা যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। ক্রমশ ক্ষয় হতে হতে লকগেটগুলিও আর মেরামতির অবস্থায় নেই।
এই অবস্থায় ফরাক্কা ব্যারাজের টেকনিক্যাল কমিটি ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে সমস্ত গেট পুনর্নির্মাণের (রিপ্লেসমেন্ট) অনুমোদন দেয়। ২০০৬ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ফরাক্কা ব্যারাজকে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক ৫৩০.৯২ কোটি টাকা পাঠিয়েছে। তার মধ্যে ৯৩ শতাংশ টাকা খরচ হয়েছে বেতন ও অন্য খাতে। অথচ ফরাক্কা ব্যারাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলেই অভিযোগ ইঞ্জিনিয়াদের।
ফরাক্কা ব্যারাজ জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুব্রত প্রামাণিক বলেন, “সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যারাজের রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে ব্যারাজ কর্তৃপক্ষকের কাছে বহু বার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু সে দাবি উপেক্ষিত হয়েছে।”
ব্যারাজ রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা বা গাফিলতির কথা অবশ্য মানতে চাননি ফরাক্কা ব্যারাজের জেনারেল ম্যানেজার সৌমিত্রকুমার হালদার। তিনি বলেন, “সব গেটের অবস্থাই অত্যন্ত খারাপ। সেগুলো বদলানো জরুরি। তার অনুমোদনও পাওয়া গিয়েছে। কাজও এগোচ্ছে। এটা তো আর দু’এক বছরের কাজ নয়। পাঁচ বছর সময় ধরা হয়েছে। তার মধ্যে কতটুকু কী করা যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্ষায় জলের চাপ থাকলেও জল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”