শাসকের কুর্সি যার, তাদের কাছেই বাঁধা

প্রতি দিন কারা যেন একটু-একটু করে মাটি ফেলে যায় পুকুরের জলে। যারা আসা-যাওয়া করে, তাদের মুখগুলো কিছু চেনা কিছু অচেনা। চেনামুখ ভয় দেখায়, লোভও দেখায়। যাতায়াতের পথে আড়চোখে দেখেন কাউন্সিলর। সকলের চোখের সামনেই বুজে যেতে থাকে পুকুর। পদস্থ কর্তারা তবে কী করেন? আইনে আটকায় না? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।প্রতি দিন কারা যেন একটু-একটু করে মাটি ফেলে যায় পুকুরের জলে। যারা আসা-যাওয়া করে, তাদের মুখগুলো কিছু চেনা কিছু অচেনা। চেনামুখ ভয় দেখায়, লোভও দেখায়। যাতায়াতের পথে আড়চোখে দেখেন কাউন্সিলর। সকলের চোখের সামনেই বুজে যেতে থাকে পুকুর। পদস্থ কর্তারা তবে কী করেন? আইনে আটকায় না? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।

Advertisement

সুস্মিত হালদার ও সৌমিত্র সিকদার

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:০২
Share:

আবর্জনায় বুজে যাচ্ছে চাকদহের সিংহের পুকুর। —নিজস্ব চিত্র।

তখন বাম জমানা চলছে। নেতাদের দাপটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খাচ্ছে। এলাকায়-এলাকায় গুটি কয়েক কংগ্রেস কর্মী। বিজেপি নেই বললেই চলে। জন্ম হয়নি তৃণমূলের। সেই সময়েই অবাধে পুকুর বোজানোর কাজে হাত পাকাতে শুরু করেছিলেন কিছু যুব নেতাকর্মী।

Advertisement

বেশি পরিশ্রম নেই। ভাল টাকা রোজগার। ঝুঁকি প্রায় নেই। পার্টি, পুলিশ, প্রশাসনের হাত রয়েছে মাথার উপরে। আর কী চাই? আস্তে আস্তে বেপরোয়া হয়ে ওঠে দাদারা। জেলার প্রবীণদের অনেকের মতেই, পুকুর বোজানোর কাজে যারা যুক্ত ছিল, তাদের অধিকাংশই সিপিএমের নেতা-কর্মী। অন্য বাম শরিকদের সে ভাবে দেখা যেত না।

অনেক সিমিএম নেতাই মন থেকে এ সব মেনে নিতে পারতেন না। তাঁরা এক সময়ে সংবাদ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে প্রতিবাদ করা শুরু করলেন। কোথাও কোথাও কাজ হলেও অধিকাংশ এলাকায় তেমন কিছুই হত না। সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরে দু’একটি জায়গায় দলীয় স্তরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। নেতা-কর্মীদের এ সব দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হতে থাকে দলের তরফে। কিন্তু সে সব সুভাষিতে কে কান দেয়?

Advertisement

সেই রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই কিন্তু খেলাটা বদলে যেতে শুরু করে। তৃণমূলের পালে যেই হাওয়া লাগতে শুরু করল, দেখা গেল অনেক জায়গাতেই সিপিএম আর তৃণমুলের লোকজন এক সঙ্গে পুকুর বোজাতে নেমেছে। শাসক আর বিরোধী হাত মিলিয়ে ফেলায় কে আর প্রতিবাদ করতে যাবে? বিনা বাধাতেই পুকুর বোজানো হয়েছে। আবার যেখানে সিপিএম তৃণমূলের লোকজনকে সঙ্গে নিতে পারেনি, সেখানে মৃদু প্রতিবাদ হয়েছে।

এর পর পালাবদল। ‘পরিবর্তন’-এর স্লোগান তুলে তৃণমূল ক্ষমতায় এল। কিন্তু পুকুর বোজানো বন্ধ তো হলই না, বরং অনেকের মতে, উল্টে তা বেড়ে গিয়েছে। আরও খোলাখুলি চলছে কারবার। পুকুর বুজিয়ে বহুতল তৈরির কাজ আরও গতি পেয়েছে। এক সময়ে যাঁরা সিপিএমের শিবিরে ছিলেন, তাঁরা এখন জার্সি বদলে নিয়েছেন শুধু। আইনকে বুড়ো আঙুল তাঁরা আগেও দেখাতেন, এখনও দেখাচ্ছেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ। চলছে মোটা টাকার লেনদেন। করিমপুর থেকে কল্যাণী, নবদ্বীপ থেকে বগুলা — সর্বত্র একই চিত্র।

অর্থাৎ গোটা বিষয়টি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলছে। শাসকের ছত্রচ্ছায়ায় জেলার মানচিত্র থেকে টলটলে জলের দৃশ্য মুছে চলেছে প্রোমোটার বাহিনী। অনেক ক্ষেত্রেই মুখগুলো একই থেকে গিয়েছে।

সিপিএম নেতারা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে রাজি নন। দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এসএম সাদির দাবি, “পুকুর বোজানো থেকে শুরু করে প্রোমোটারি, রাহাজানি — সবই তৃণমূলের আমদানি। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে জলাশয়, সব ওরা লুট করতে শুরু করেছে। দেখলেন না হাওড়ায় কী হল? প্রোমোটারি নিয়ে খুনের ঘটনায় খোদ মন্ত্রীর নাম জড়িয়ে গেল!”

কিন্তু আপনাদের সময়েও তো একের পর এক পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে উঠেছে বহুতল? সাদির দাবি, “আমাদের সময়ে তেমন যেখানেই হয়েছে, আমরা আইনানুগ পদক্ষেপ করেছি।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের পাল্টা দাবি, “সবই সিপিএমের আমদানি। ওদের হার্মাদ বাহিনীই তো এ সব করত। সেই হার্মাদ বাহিনী এখন বিজেপির জল্লাদ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।” কিন্তু এখনও তো একই ভাবে পুকুর ভরাট হয়ে চলেছে? গৌরী বলেন, “আমাদের সময়ে এমন কিছু ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। জানতে নিশ্চয়ই পদক্ষেপ করা হত।”

কে না জানে, নেতারা কখনও মিথ্যে বলেন না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন