সঘন বরষায় ২

আষাঢ়ে আছাড়ে ফেরে মনখারাপ

দারুণ দহন অন্তে সে এসেছে — ভরা নদী, স্কুল-ছুটি, চপ-মুড়ি কিংবা নিঝুম দুপুর-রাতে ব্যাঙের কোরাস নিয়ে সঘন বরষা রয়েছে কি আগের মতোই? কিছু প্রশ্ন,কিছু স্মৃতি নিয়ে সেই কাদা-জলে পা রাখল আনন্দবাজার। দারুণ দহন অন্তে সে এসেছে — ভরা নদী, স্কুল-ছুটি, চপ-মুড়ি কিংবা নিঝুম দুপুর-রাতে ব্যাঙের কোরাস নিয়ে সঘন বরষা রয়েছে কি আগের মতোই? কিছু প্রশ্ন,কিছু স্মৃতি নিয়ে সেই কাদা-জলে পা রাখল আনন্দবাজার।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ০৭:০০
Share:

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

শহর থেকে নৌকায় গাঁয়ে ফিরছে সে। সদ্য কলেজ পাশ ছেলে এ ক’দিনেই বাবু হয়ে উঠেছে।

Advertisement

নৌকা ভিড়ল ঘাটে। পাড়ে নামার তর সইল না তার। মাঝিদের বারণ তুড়িতে উড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে সাত তাড়াতাড়ি নামতে গেল, আর সুটকেস হাতে টালমাটাল বাবু নদীর কাদায় চিৎপাত।

মনে পড়ছে ‘সমাপ্তি’র অমূল্য, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। কাদায় মাখামাখি পরনের পাটভাঙ্গা ধুতি, কোট। শহুরে বাবুর দুর্দশায় হাসি চাপতে পারল না মৃণ্ময়ী, অপর্ণা সেন। কাদামাখা লোকটা কটমটিয়ে চাইতেই কিশোরী মেয়ে দে ছুট।

Advertisement

সত্যজিত রায়ের সমাপ্তির শুরুতেই সেই আছাড় এখনও মনে আছে দর্শকদের।

একটা সময় ছিল, যখন বর্ষার একঘেয়ে বৃষ্টির জলে, কাদায় সব পথই মহাপ্রস্থানের হয়ে উঠত। হাঁটু অবধি ডুবে যাওয়া সে পথে ভানুসিংহের রাধারানি থেকে রামা কৈবর্ত সকলকেই সামলে চলতে হত। গ্রামের রসিকজন সে কাদাকে ভালোবেসে ‘দধিকাদা’ বলে ডাকতেন। চলার পথ থেকে গৃহস্থের উঠোন সবই যেন ইন্দ্রপ্রস্থের পান্ডব প্রাসাদ। বেচারা দুর্যোধনের মতো পদে পদে লজ্জার আছাড়।

প্রসঙ্গ উঠতেই ভরতপুরের কেদার বাঁড়ুজ্জে ডাউন মেমারি লেন ধরে পৌঁছে যাচ্ছেন পঞ্চাশ বছর আগে— সবে বিয়ে করেছেন। সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনার কৌলিন্যে পাকা অ্যাসফাল্ট তখনও সুদূর। ছিল না মোরাম বিছানোর কোনও ছিমছাম সরণি। খটখটে মাটির রাস্তায় ঠা ঠা রোদের দিনে ‘চলতে চরণ ধুলায় ধূসর’ হত। সঘন বর্ষায় হাঁটু সমান কাদা। মাটির চরিত্র ভেদে কখনও পায়ের পাতা ডোবানো, পিচ্ছিল সে রাস্তায় পা টিপে টিপে আঙুল আঁকড়ে চলাই দায়।

বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া ‘হারকিউলিস’ সাইকেলের পিছনে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে চাপিয়ে কেদার বাঁডুজ্জে চলেছেন শ্বশুরবাড়ি। যেন সদ্য বিয়ে করে বাঞ্ছারামের নাতবউকে সঙ্গে নিয়ে খুশিতে ডগমড নাতি ফিরছে বাগানে। গান বাজছে ‘ওরে এক অচিন পাখি উড়ে উড়ে এল আমার বুকের ভাঙা খাঁচাতে...’ প্রায় পৌঁছেও গিয়েছেন। এমন সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। সেই জলে রাঢ়ের এঁটেল মাটি মুহূর্তে পিচ্ছিল। ভারসাম্য হারিয়ে সস্ত্রীক পতন। চন্দনতুলসী হয়ে নতুন জামাইবাবাজি প্রথম বার বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঢুকতেই হো হো হাসির রোল! এখন সে দুপুরটা ভাবলে বডড মনকেমন করে কেদারের।

শৈশবের গ্রামে পিচ্ছিল কাদামাটি ছিল আনন্দের উৎস। বৃষ্টি হলে দল বেঁধে গ্রামের কাদার মাঠে নেমে হাডুডু, কবাডি খেলার ধুম পড়ে যেত। পিছলে পড়ে নির্মল হাসির খোরাক হয়ে ওঠাই ছিল খেলার মজা। দৌলতবাদের আজাহার আলি, বিভু মালাকার এখনও বৃষ্টি পড়লেই মনে মনে এক ছুটে চলে যান নওদাপাড়ার সেই মাঠে।

মাটির পথে পিচ পড়তেই কাজ ফুরিয়েছে পেল্লায় দুটি চাকাওয়ালা গরু এবং মোষের গাড়ির। সেকালের গণ পরিবহণের অন্যতম গরুর গাড়ি বর্ষাকালে হামেশাই কাদায় পড়ত। ফসল বোঝাই গাড়ি গ্রামের মানুষই কাঁধে করে তুলে দিতেন। তার জন্য গাড়ির মালিকের রাজনৈতিক রং-এর খোঁজ করতেন না কেউই। বর্ষা হোক ঘনঘোর কিম্বা রিমঝিম। এমন দিনে ‘টোপর’ দেওয়া গরু বা মোষের গাড়ির ভিতরে বসে বর-কনের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার রোমান্সের স্বাদই অন্যরকম। সুচিত্রাকে গতির পিঠে চড়িয়ে উত্তমকুমার যতই ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গেয়ে যান, ওই যাত্রার স্বাদই আলাদা।

আবার বর্ষাপথের কাদার সূত্রেই সম্রাট শশাঙ্কের হারিয়ে যাওয়া রাজধানীর খোঁজ পান ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সময়টা উনিশ শতকের প্রথম দিক। বহরমপুরে নিজের বাড়িতে এসেছেন রাখালদাস। জমিদার মানুষ। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কর্ণসুবর্ণ এলাকার বাসিন্দা এক দিনমজুর। রাখালদাসের নজর গেল লোকটির পায়ের দিকে। অদ্ভুত লালচে রঙের কাদা দেখেই সন্দেহ হয় তাঁর। উঠোন থেকে ঘরে ডেকে আনেন সেই কিসানকে। ছেলেকে ডেকে বলেন, ‘আন হেঁসো!’

গতিক দেখে সেই ক্ষুদ্র চাষি তো কেঁদে সারা। আর রাখালদাস, নিজে হাতে সেই অদ্ভুত রঙিন কাদা চেঁচে নমুনা সংগ্রহ করে পাঠালেন পরীক্ষার জন্য। দেখা গেল তাঁর অনুমান অভ্রান্ত— ওই কাদা আসলে ষষ্ঠ শতকের রাজা শশাঙ্কের আমলের নিদর্শন।

বর্ষার সেই কাদা-পাঁক আর নিপুণ আছাড়, পিচ রাস্তার দাপটে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন