নদীর খেয়ালে পাল্টেছে জীবন

নদীর গতিপথ পাল্টেছে। সেই সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানা এলাকার দেওয়ানসরাই গ্রাম পঞ্চয়েতের চর গয়েসপুর গ্রামের ভাগ্যটাই। লালগোলা থানা এলাকার পুরো ভূখণ্ডটি রয়েছে ভাগীরথী নদীর পূর্ব পাড়ে। ব্যতিক্রম কেবল চর গয়েসপুর। একদা ওই গ্রামটিও ছিল নদীর পূর্ব পাড়েই।

Advertisement

অনল আবেদিন

লালগোলা শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৫৩
Share:

(বাঁ দিকে) পড়ে আছে সেই শিলা। (ডান দিকে) টাঙানো রয়েছে রাস্তা তৈরির সাইনবোর্ড। —নিজস্ব চিত্র

নদীর গতিপথ পাল্টেছে। সেই সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানা এলাকার দেওয়ানসরাই গ্রাম পঞ্চয়েতের চর গয়েসপুর গ্রামের ভাগ্যটাই। লালগোলা থানা এলাকার পুরো ভূখণ্ডটি রয়েছে ভাগীরথী নদীর পূর্ব পাড়ে। ব্যতিক্রম কেবল চর গয়েসপুর। একদা ওই গ্রামটিও ছিল নদীর পূর্ব পাড়েই। স্মরণাতীত কালে নদীর গতিপথের পরিবর্তন হওয়ায় গ্রামটির অবস্থান হয়েছে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে। তার ফলে রেশন দোকান, গ্রাম পঞ্চায়েত, কৃষি উন্নয়ন কার্যালয়, ভূমি দফতর, থানা, পঞ্চায়েত সমিতি-সহ ব্লক পর্যায়ের যাবতীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পরিষেবা পেতে প্রতি পদে নিদারুণ মূল্য দিতে হচ্ছে ওই গ্রামের ৩৫০০ বাসিন্দাকে।

Advertisement

রেশন কার্ডের কথাই ধরা যাক। নতুন রেশন কার্ড করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন লিখিত আবেদন। আবেদনপত্র জমা দিতে যেতে হবে লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতি কার্যালয় লাগোয়া খাদ্য সরবরাহ দফতরের কার্যালয়ে। কীভাবে যাবেন? চর গয়েসপুর গ্রামের প্রান্তে রয়েছে ফেরিঘাট। নৌকায় নদী পেরিয়ে পা পড়বে ভগবানগোলা থানার আরিজপুরে। সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যেতে হবে ভগবানগোলা থানা এলাকার ওড়াহার-সুন্দপুর লছিমন স্ট্যান্ডে। এর পর লছিমনে চেপে ভগবানগোলা থানা এলাকার ৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দূরে যশোইতলা মোড়। সেখানে পৌঁছে বাস ধরে নামতে হবে ৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে লালগোলা বাসস্টপে। এ বার রিকশা, বা টুকটুকে করে পৌঁছনো যাবে দেড় কিলোমিটার দূরের খাদ্য সরবরাহ দফতরের ব্লক কার্যালয়ে।

থানা, পঞ্চায়েত সমিতি, ব্লক অফিস, ভূমি, কৃষি ও প্রাণীসম্পদ দফতরের ব্লক পর্যায়ের কার্যালয়গুলিতেও যেতে হবে একই ভাবে নৌকায়, হেঁটে, লছিমনে, বাসে ও সব শেষে রিকশায় মিলিয়ে মোট পাঁচ বার নানারকম যানবাহন পাাল্টে ২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। তৃণমূলের চর গয়েসপুর বুথ কমিটির সভাপতি মতিউর রহমান ও সম্পাদক সাদরুল আমিন ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, “জন্ম-মৃত্যুর শংসাপত্র নিতে গেলেও এভাবেই পঞ্চায়েত অফিসে যেতে হয়। অথচ আমাদের গ্রাম থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই রয়েছে সাগরদিঘি থানা এলাকার কাবিলপুর গ্রাম পঞ্চায়েত ভবন। দেওয়ানসরাই পঞ্চায়েত ও লালগোলা থানা এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে চর গয়েসপুরকে কাবিলপুর পঞ্চায়েত ও সাগরিদিঘি থানার অন্তর্ভূক্ত করা হলে আমরা এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাই।”

Advertisement

গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের জানমহম্মদ শেখ গ্রামের পথে টাঙিয়ে রাখা একটা সরকারি সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, “ওই দেখুন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ। রাজ্যের ১৬ হাজার গ্রামের সঙ্গে আমাদের গ্রামের রাস্তাটিও কংক্রিট ঢালাই করার জন্য গত ৭ জানুয়ারি শিলান্যাস করেন বিডিও-র প্রতিনিধি হিসাবে ব্লক ইনফরমেটিভ অফিসার বিশ্বজিৎ মুর্মু। শিলান্যাস অনুষ্ঠানের জন্য হাজার চারেক টাকাও খরচ হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পর আট মাস অতিক্রান্ত। আজও ২ লক্ষ ২১ হাজার ৫৯০ টাকার ওই প্রকল্পটির কাজ শুরুই হয়নি।” ফলে ব্লক ও পঞ্চায়েত পরিবর্তন করে কাবিলপুর ও সাগরদিঘির সঙ্গে চর গয়েসপুরের সংযুক্তকরণ বাসিন্দাদের কাছে দিবাস্বপ্নের মতো।

প্রস্তাবিত ঢালাই রাস্তার প্রসঙ্গে লালগোলা ব্লক ইনফরমেটিভ অফিসার বিশ্বজিৎ মুর্মুর সোজাসাপটা জবাব, “১০০ দিনের কাজের প্রকল্প থেকে ওই রাস্তাটি ক্রংক্রিট ঢালাই করা হবে। লালগোলা ব্লকের ১০০ দিনের কাজের দায়িত্বে আছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট অফিসার (এপিও) সুকল্যাণ রায়। তিনিই এ বিষয়ে ঠিকঠাক বলতে পারবেন।”

সুকল্যাণবাবু বলেন, “কোনও গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এক বছরে ১০০ দিনের কাজের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ মাটির কাজ হয়ে থাকলে তবেই সেই বছরে শতকরা ৪০ ভাগ টাকায় কংক্রিট ঢালাই রাস্তা করা যাবে। দেওয়ানসরাই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় মাটির কাজের সেই লক্ষ মাত্রা পূরণ হয়নি। নিয়ম অনুসারে চর গয়েসপুরে ঢালাই রাস্তা নির্মাণ করা যায়নি।” রাস্তা না হলেও সাগরদিঘি ব্লকের সঙ্গে চর গয়েসপুরের সংযুক্তিকরণের বিষয়ে তদ্বির করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী কংগ্রেসের দীপশিখা হালদার। তিনি বলেন, “তবে ওই গ্রামের লোকজনকে আগে লিখিত আবেদন করতে হবে।”

আবেদনপত্র জমা দিলেই লাগোয়া সাগরদিঘি ব্লকের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ হয়ে যাবে এই আপ্তবাক্যে ভরসা করতে পারছেন না গ্রামবাসীরা। চর গয়েসপুরের রেশন দোকান রয়েছে নদীর অপর পাড়ে আট কিলোমিটার দূরে জগন্নাথপুর গ্রামে।

পঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের জানমহম্মদ শেখ বলেন, “নদী পার হয়ে ঝড়-বাদল মাথায় নিয়ে রেশন নিতে যেতে হয় আট কিলোমিটার দূরে জগন্নাথপুর গ্রামে। এ কারণে আমাদের গ্রামে পৃথক একটি রেশন দোকান করার জন্য খাদ্য দফতরে কয়েক বছরে অনেক বার আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়। কিন্তু আজও কোনও সুরহা হয়নি।” খাদ্য সরবরাহ নিগমের লালবাগ মহকুমা নিয়ামক অবনী রজক অবশ্য বলেন, “কয়েক দিনের মধ্যে আমি নিজে ওই গ্রামে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে পৃথক রেশন দোকানের ব্যবস্থা করব।”

তদন্তের কথা শুনে হেসেই ফেললেন চর গয়েসপুরের ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। জানমহম্মদ শেখ বলেন, “খাদ্য সরবরাহ নিগমের লালবাগ মহকুমার এর আগের নিয়ামকও একই রকম তদন্তের কথা বলেছিলেন। তারপর বছর ঘুরতে চলল। তিনি বদলি হয়েছেন। তদন্ত কিন্তু হয়নি। এখন অবনীবাবু এসেছেন। তিনিও তদন্তের কথা বলছেন।

শেষ পর্যন্ত সত্যি তদন্ত হবে তো? ৩৫০০ লোকের বাসস্থান গয়েসপুরের কপালে পৃথক রেশন দোকান আদৌ মিলবে কি?”

—নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন