গরমে বোঁটা শুকিয়ে ঝরছে আম

নবাবের দেশের রানি কিংবা চম্পা। কহিতুর কিংবা হিমসাগর। নাম শুনলেই জিভে জল আসে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাদ যায় না পাশের জেলা নদিয়াও। অথচ এ বছর অনাবৃষ্টির কোপে পড়ে সেই আম নাকি এ বছর অমিল হতে বসেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৫৪
Share:

নবাবের দেশের রানি কিংবা চম্পা। কহিতুর কিংবা হিমসাগর। নাম শুনলেই জিভে জল আসে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাদ যায় না পাশের জেলা নদিয়াও। অথচ এ বছর অনাবৃষ্টির কোপে পড়ে সেই আম নাকি এ বছর অমিল হতে বসেছে।

Advertisement

গত বছর প্রায় জলের দরে বিকিয়েছে আম। চাষিরা ভেবেছিলেন, এ বার বুঝি সেই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে যাবে। কিন্তু সেটা তো হলই না বরং তীব্র গরমে চাষিদের কপালই যেন পুড়তে বসেছে। মুর্শিদাবাদ জেলার উদ্যানপালন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের এই সময়ে বাতাসে গড় আর্দ্রতার পরিমাণ থাকে ৭০ শতাংশ। মুর্শিদাবাদে তার পরিমাণ ৯৩ শতাংশ। আর সেই কারণেই বিহার ও উত্তরপ্রদেশের আমের রং ও চেহারা অনেকটাই উন্নত। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের আম ৩৫ থেকে ৪৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। তার কম বা বেশি হলেই ক্ষতি হয়ে যায়।

এমনিতেই এ বার আমের ‘অফ ইয়ার’। ফলন কম হওয়ার কথা। তার উপরে অনাবৃষ্টির কারণে আমের বোঁটা শুকিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এরপরও গাছে যা আম অবশিষ্ট থাকবে, তার মানও খারাপ হবে। সব মিলিয়ে চাষিরা এ বছর গভীর সঙ্কটে। কিন্তু আমের উপরে ভরসা করেই সংসার চলে বহু মানুষের। নদিয়ার হিমসাগর আর ল্যাংড়ার কদর বাঙালির ঘরে ঘরে। আর পাঁচটা আমের চেয়ে স্বাদ আর গন্ধের জন্য এই জেলার আমের চাহিদা এমনিতেই বেশি। এর বাইরেও আছে সিন্দুরটোকা, গোলাপখাস, বোম্বাই, মোহনভোগ, কিষাণভোগের মতো আম। মুর্শিদাবাদের প্রায় একশো প্রজাতির আম হয়। তার মধ্যে রানি, ভবানী, বিমলী, বিড়া, চন্দনখোসা, সড়াঙ্গা, বড় সিন্দুর, ছোট সিন্দুর, আনারস, কহিতুর, চম্পা বা চাঁপা বিখ্যাত। এখানের মানু‌ষের বিশ্বাস, স্বাদ ও গন্ধে এই আম দেশের অন্য প্রদেশের আমের সঙ্গে সমান ভাবে পাল্লা দিতে পারে। এর পাশাপাশি আম্রপালি আমেরও চাষ শুরু হয়েছে। মরসুমে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়।

Advertisement

ভিন রাজ্যের পাইকারি আম ব্যবসায়ীরাও ভিড় জমান এই দুই জেলায়। বিহার, উত্তর প্রদেশের ব্যবসায়ীরা রীতিমতো ঘর ভাড়া করে থেকে আম কিনে নিজেদের রাজ্যে সরবরাহ করেন। কিন্তু এ বার যে বাজার ভালো মিলবে না, তা বুঝে গিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আম ব্যবসায়ী মাজদিয়ার অমর সিংহ বলেন, ‘‘গত বছর এত ফলন হয়েছিল যে আম জলের দরে বিক্রি হয়েছিল। এ বার ঠিক তার উল্টোটা। বাজারে এ বার আমের আকাল দেখা দেবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সমস্ত আম গাছ থেকে ঝড়ে যাচ্ছে। মানও কমে যাবে। ফলে যদিও বা বাজারে কিছু আম আসে তার দাম মিলবে না।’’

কেবল নদিয়াতেই প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। মুর্শিদাবাদে এ বার প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। গত বছর এই জেলায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হতে পারে বলে মুর্শিদাবাদ জেলার উদ্যানপালন দফতরের দাবি। শিবনিবাস এলাকার আম চাষি নৃপেন্দ্রনাথ শুকুল এ বারও প্রায় ২৩৫টি আম গাছ নিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এক ফোঁটাও বৃষ্টি হল ‌না। জলের অভাবে চোখের সামনে বোঁটা শুকিয়ে আমগুলো সব গাছ থেকে ঝরে যাচ্ছে। গাছে আম প্রায় নেই বললেই চলে। যে ক’টা এখনও টিকে আছে, তাদের বোঁটাও খুবই হালকা হয়ে গিয়েছে। এই মুহুর্তে যদি সামান্য ঝড় হয় তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে।’’

অথচ এই সময় যে কোনও মুহুর্তে কালবৈশাখী ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর সেটা যদি হয় তা হলে সেই ঝড়ে আমের সঙ্গে সঙ্গে চাষিরাও মুখ থুবড়ে পড়বে বলেই মনে করছেন অনেকে। নদিয়া জেলার উদ্যানবিদ কৃষ্ণেন্দু ঘোড়াই বলেন, ‘‘অনাবৃষ্টির কারণে গাছ থেকে আম তো ঝরে পড়ছেই, তার উপরে আরও একটা বড় সমস্যা হল, এই আম আকারে তেমন বড় হবে না। নির্দিষ্ট সময়ের আগে পেকে যাবে। সব মিলিয়ে আমের মান নেমে যাবে।’’

তা হলে এর হাত থেকে বাঁচার উপায়? তিনি বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে গাছে সেচের মাধ্যমে জল দেওয়ার।’’ মুর্শিদাবাদের উদ্যানবিদ গৌতম রায় বলেন, ‘‘এ রকম গরমে আমের গুটি ঝরে পড়ে। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এ বছর গাছে মুকুলের পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হওয়ায় গুটি ঝরে পড়ার হারও কম। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় আমের আকার, আয়তন ও মিষ্টতা কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অত্যধিক গরমের কারণে আমের রং খারাপ হতে পারে। আমের গায়ে ছোপ ছোপ কালচে ধরনের রং হতে পারে। অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে পোকা ও ছত্রাকের উপদ্রব বাড়বে।’’

তবে এই উচ্চ তাপমাত্রায় বাগানে জল সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেখানে সেটা নেই, সেখানে অনুখাদ্য জলে গুলে গাছের পাতায় ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। কিন্তু গাছে সেচের জল দেওয়া যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলেই মনে করছেন নদিয়ার অনেক চাষি। সেই কারণে তাঁরা সে রাস্তায় হাঁটছেন না। তাঁদের কথায়, ‘‘একবার জল দিলে সেটা চালিয়ে যেতে হবে। সব সময় সেটা সম্ভব হয় না। তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তার উপরে খরচও অনেকটা বেশি পড়ে যাবে।’’ তাঁদের কথায়,‘‘এমনিতেই এবার ক্ষতি নিশ্চিত। তার উপর হাজার হাজার টাকা খরচ করে জলে দিতে গিয়ে আরও বেশি করে লোকশানের মুখে পড়তে চাই না।’’ তবে মুর্শিদাবাদের চাষিরা কিন্তু অনেকই সেচ দিচ্ছেন।

আমের ক্ষতি থেকে বাঁচার কি অন্য কোনও উপায় নেই? কৃষি বিজ্ঞানীরা কিন্তু বলছেন, উপায় আছে। পরিকল্পিত ভাবে সঠিক পরিকাঠামো তৈরি করতে পারলেই এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অসিত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই এলাকায় প্রাক মৌসুমী বৃষ্টিপাত কয়েক বছর ধরে যেমন হয়েছে, এ বার তার কিছুই হয়নি। আর এটাই সঙ্কটের মূল কথা।’’ তিনি বলেন,‘‘কিন্তু এই আশঙ্কা সব সময়ই ছিল। তাই বিকল্প সেচের ব্যবস্থাটা তৈরি করে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু তা করা হয় নি। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আম চাষিদের।’’ তিনি বলেন, ‘‘এই মুহুর্তে ‘ডিপ ইরিগেশন’ বা পাইপের সাহায্যে গাছের গোড়ায় ফোঁটা ফোঁটা জল দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যেতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন