কর্তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বিয়ে, মা হচ্ছে নাবালিকারা

ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ে! ছুঁড়ি হয়তো বইখাতা চক-পেন্সিলে ব্যস্ত বা নিদেনপক্ষে পুতুল খেলছে। সেখান থেকেই তাকে তুলে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘সোহাগের বিছানায়’।

Advertisement

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায় ও সামসুদ্দিন বিশ্বাস

কৃষ্ণনগর ও বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:৫১
Share:

ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ে!

Advertisement

ছুঁড়ি হয়তো বইখাতা চক-পেন্সিলে ব্যস্ত বা নিদেনপক্ষে পুতুল খেলছে। সেখান থেকেই তাকে তুলে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘সোহাগের বিছানায়’।

বছর না ঘুরতেই ছোট্ট মেয়েটা মা, কোলে জ্যান্ত পুতুল। অবশ্যই সেই পুতুলকে পৃথিবীতে আনতে গিয়ে যদি না সে-ই চোখ বোজে।

Advertisement

সরকার বলছে, নাবালিকা বিয়ে আটকাতে দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়েছে কন্যাশ্রী যোদ্ধারা। তুমুল প্রচার চলছে গাঁয়ে-গঞ্জে। হিসেব বলছে, চলতি বছরে নদিয়ায় অন্তত ছ’হাজার নাবালিকার বিয়ে হয়েছে। সেখানে মাত্র ৭৮ জন নাবালিকার বিয়ে রুখতে পেরেছে প্রশাসন। গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে ২৬ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। মুর্শিদাবাদ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভাশিস সাহা নিজেই কবুল করছেন, সরকারি হাসপাতালে ভূমিষ্ট হওয়া শিশুদের ২০ শতাংশের মায়ের বয়স ২০ বছরের নীচে। এ বছর জঙ্গিপুর প্রায় ১২০০ প্রসূতিরও ২০ শতাংশ নাবালিকা। প্রসবের সময়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ৯ শতাংশ মাধ্যমিক পাশ, ৩ শতাংশ স্নাতক। ‘‘অক্ষরজ্ঞানহীনেরাই বেশি মারা যাচ্ছে’’— বলছেন কর্তা।

সেটাই স্বাভাবিক।

অশিক্ষা ও অজ্ঞানতাই কম বয়সে মেয়ের বিয়ের মূলে। আর অপ্রস্তুত শরীরে সন্তানধারণ করতে গিয়েই হচ্ছে মৃত্যু। প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে, নাবালিকা বিয়ে বন্ধ রুখতেই কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করা হচ্ছে। নাবালিকা বিয়ের তোড়জোড় হচ্ছে শুনলেই তা বন্ধ করা হচ্ছে। এ বছরে নদিয়ায় ৭৮টি এ রকম বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। তার পর? কী হচ্ছে সেই সব মেয়েদের? তাদের বাড়ির লোকজন সুড়সুড় করে তাদের স্কুলে-কলেজে পড়া চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে? নাকি হইচই একটু কমে গেলেই অন্য এলাকায় নিয়ে গিয়ে বেড়াল পার করা হচ্ছে?

ইদানীং কালে নাবালিকাদের বিয়ে রোখায় সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া। সেখানে মাস কয়েক আগে বিয়ে ঠিক হয় মালোপাড়ার বছর সতেরোর সামিমা সুলতানার। কিন্তু মেয়েটি বেঁকে বসে। প্রথমে স্কুলের শিক্ষকের সাহায্য নেয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেয়। শেষে বার মানতে বাধ্য হন বাবা-মা।

কিন্তু এমন নাছোড় জেদ তো বেশি মেয়ের থাকে না। অনের ক্ষেত্রে তো স্কুলপড়ুয়া মেয়েদেরই সচেতনতার অভাব থাকে। প্রশাসন তাদের বিয়ে আটকে দিলেও তারা পরে পরিবারের কথাতেই চলে। ফল? কিছু দিনের মধ্যেই গোপনে বিয়ে হয়ে যাওয়া।

এমনটাই অভিজ্ঞতা নাবালিকা বিয়ে রোখার কাজে যুক্ত বেসরকারি সংস্থার কর্মীদেরও। এমন এক কর্মী ফেরদৌসি বেগমের হিসেবে, গত আট মাসে হরিহরপাড়া ও বেলডাঙা ১ ব্লক মিলে ২১৫টা বিয়ে বন্ধ করা গিয়েছে। কখনও পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে বন্ধ করেছেন। ‘‘কিন্তু অন্তত ৮০টা মেয়ের এক মাসের মধ্যে আত্মীয়দের বাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে গিয়েছে’’— আক্ষেপ করেন ফেরদৌসি।

মাস ছয়েক আগে বেলডাঙার মির্জাপুর ও ভাবতা অঞ্চলে প্রথমে বিয়ে বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু পরে ওই মেয়েদের মাসির বাড়ি-কাকার বাড়ি নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু দিন আগে বেলডাঙা পুরসভা ঘেঁষা এলাকায় একটি মেয়ের বিয়ে আটকে দিয়েছিল প্রশাসন। যে ছেলেটির সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার কথা হয়েছিল, তার সঙ্গেই তাকে ‘পালিয়ে’ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় বাড়ির লোকজন।

হরিহরপাড়ার স্বরূপপুরে সামসের শেখের মেয়ে মর্জিনার বিয়েও আটকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দু’মাসের মধ্যে এক কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। নওদার বালি অঞ্চলের আফতাব শেখ ১৬ বছর বয়সে মেয়ের দিচ্ছিল। প্রশাসন বন্ধ করে। এক মাসের মধ্যে একই পাত্রের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কেন এই হাল? সমাজকর্মীরা তার জন্য প্রশাসনের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন। তাঁদের অভিযোগ, দরকারের তুলনায় প্রচার নেহাতই অকিঞ্চিৎকর। খবর দেওয়া হলেও বহু সময়ে প্রশাসন নির্বিকার। উল্টে নাবালিকা বিয়ে আটকাতে গিয়ে সমাজকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। নদিয়ার জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত অবশ্য মনে করেন, “সব চেষ্টা হচ্ছে। নাবালিকার বিয়ে একেবারে বন্ধ হতে কিছুটা সময় লাগবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন