পুণ্যের-লোভে: স্নানের আগে জমায়েত। নিজস্ব চিত্র
উৎসব নিয়েই বাঁচে নবদ্বীপ। বৈশাখ থেকে চৈত্র—বারোমাস চেনা-অচেনা বিচিত্র উৎসবে ঠাসা নবদ্বীপের নিজস্ব ক্যালেন্ডার। চৈতন্যধামের সেই উৎসব সরণিতে নতুন সংযোজন ‘রাধাকুণ্ডের স্নান’। হাজার বছরের প্রাচীন এই শহরের দু’শো-তিনশো বছর ধরে চলে আসা নানা উৎসব অনুষ্ঠানের ভিড়ে সদ্যোজাত এই উৎসবে শুরু থেকেই মানুষের ঢল।
বুধবার রাত বাড়তেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় মানুষের ভিড়। বেশির ভাগই অপরিচিত মুখ। ছোট বড় নানা রকমের গাড়ি করে দলে-দলে মহিলা-পুরুষ খোল-করতাল বাজিয়ে সংকীর্তন সহযোগে আসছেন শহরে। কোনও কোনও দল পদব্রজে বিরাট শোভাযাত্রা করে চলেছেন। সকলেই স্নানের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। গন্তব্য নবদ্বীপে গঙ্গার কোনও একটি ঘাট।
নবদ্বীপের এ রাতে অধিকাংশ মানুষই এসেছেন বাইরে থেকে। নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগণা, মেদিনীপুর থেকে আসা মানুষের ভিড় উপচে পড়েছে শহরে। সাধারণত দোলের সময় নবদ্বীপ জুড়ে সারা দিন-রাত এ ভাবে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য নগরকীর্তনের দল। কিন্তু কার্তিক মাসের হিমেল রাতে হাজার-হাজার মানুষ কেন এ ভাবে পথে নেমেছেন?
আসলে দুর্গাষ্টমীর পরের অষ্টমী তিথি বৈষ্ণবদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তিথি। বহুলাষ্টমী নামে পরিচিত ওই তিথিতে বৃন্দাবনের রাধাকুণ্ডের স্নানযোগ। এ সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখো বৈষ্ণব ভক্ত, সাধকেরা বৃন্দাবনে ভিড় জমান রাধাকুণ্ডের জলে স্নান করার জন্য। কুম্ভমেলা বা মকর স্নানের থেকে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এই স্নান। বৈষ্ণব পঞ্জিকায় সেই স্নানের তিথি, সময়, সবকিছু স্বতন্ত্র ভাবে উল্লেখ করা থাকে।
সম্প্রতি বৈষ্ণবদের কাছে গুপ্ত বৃন্দাবন বলে পরিচিত নবদ্বীপেও বিপুল সংখ্যক মানুষ রাধাকুণ্ডের বিকল্প হিসাবে ওই তিথিতে নির্ধারিত সময়ে মেনেই স্নান করছেন গঙ্গায়। সেই সঙ্গে বৃন্দাবনের মতোই কীর্তন নগর পরিক্রমায় অংশ নিচ্ছেন।
বুধবার ছিল সেই বহুলাষ্টমী। স্নানের সময় ছিল রাত ১২.০৩ মিনিটের পর। এই উপলক্ষে রাত বাড়তেই শহরে গঙ্গার ঘাটমুখী সবকটি রাস্তায় ভিড়। রানিরঘাট, বড়াল ঘাট, শ্রীবাসঅঙ্গন ঘাট, পোড়াঘাট, ফাঁসিতলা ঘাট, জন্মস্থান আশ্রম ঘাটের রাস্তায় চার চাকা, ম্যাটাডোর, লছিমন, অটো, এমনকি ছোট লরিতে করে জমায়েত হওয়া হাজার হাজার মানুষের ভিড়। রাত যত বাড়ল, গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ভিড়।
দুর্গাষ্টমীর পরের কৃষ্ণা অষ্টমী তিথি বা বহুলাষ্টমীতে রাধাকুণ্ডের স্নান ঘিরে কেন এই উন্মাদনা? বলা হয়, এই দিনেই নাকি বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় শ্যামকুণ্ড ও রাধারানির ইচ্ছায় উৎপত্তি হয়েছিল রাধাকুণ্ডের। ভক্তদের বিশ্বাস, এ দিনে রাধাকুণ্ডে স্নান করলে যাবতীয় পাপ দূর হয়। মহাজনি পদে গাওয়া হয়— “একবার রাধাকুণ্ডে যে বা করে স্নান। রাধাসম প্রেম, তারে কৃষ্ণ করে দান।”
‘শ্রীগর্গসংহিতা’ অনুসারে শাপগ্রস্ত অরিষ্টাসুর বৃষরূপ ধারণ করে কংসের নির্দেশে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের হাতে অরিষ্টাসুর মৃত্যু বরণ করে শাপমুক্ত হন। কিন্তু প্রাণীহত্যার পাপ শ্রীকৃষ্ণকে স্পর্শ করেছে বলে রাধারানি এবং অন্য ব্রজগোপীরা তাঁকে সর্বতীর্থের জলে স্নান করে পাপমুক্ত হতে বলেন। কৃষ্ণ তাঁর পায়ের আঘাতে এক কুণ্ড খনন করে সমস্ত তীর্থকে সেখানে আহ্বান করে এনে সে জলে স্নান করেন। দেখাদেখি শ্রীমতীও হাতের কঙ্কনের আঘাতে পাশেই খনন করেন আরও এক কুণ্ড। এই দুই কুণ্ডই রাধা এবং শ্যামকুণ্ড নামে বৈষ্ণবমণ্ডলে খ্যাত। সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের বহুলাষ্টমী। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, যিনি এই তিথিতে রাধাকুণ্ডে স্নান করবেন তিনি সর্বপাপ মুক্ত হবেন। এই বিশ্বাস থেকেই ওই তিথিতে রাধাকুণ্ডের স্নান বৃন্দাবনের অন্যতম বড় উৎসব।
তবে মাত্র বছর চারেক বয়সের এই নতুন উৎসব ঘিরে এবার আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়েছিল নবদ্বীপের প্রশাসন। গঙ্গার প্রতিটি ঘাটে ছিল পর্যাপ্ত পুলিশ। সিভিল ডিফেন্সের তরফ থেকে ঘাটে-ঘাটে দড়ি দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছিল স্নানের জায়গা।
রানিরঘাটে স্নানের তদারকি করতে করতে স্থানীয় পুরসভার পুরপরিষদ সদস্য ও কাউন্সিলর মিহিরকান্তি পাল জানান, “এই তিথিতে মুষ্টিমেয় কিছু ভক্ত বৈষ্ণব চিরকালই স্নান করতেন। তবে সে সংখ্যাটা নিতান্তই দু’দশ জন। গত তিন-চার বছর ধরে উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে। অস্বাভাবিক সংখ্যায় মানুষ আসছেন। এই স্নান নবদ্বীপে নতুন উৎসব হয়ে গেল।”