বছর এগারোর নিকোলাস বই পড়ে ভক্ত হয়ে উঠেছিল ইতালি শহরের। ভারি শখ সেখানে বেড়াতে যাওয়ার। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কতই বা দূর ইতালি! সাংবাদিক বাবা একদিন নিকোলাস, তার মা ও বোনকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে ইতালি চললেন। পথে গাড়ি লক্ষ্য করে দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলি লাগে নিকোলাসের মাথায়। ডাক্তারেরা জানান, ‘ব্রেন ডেথ’ হয়েছে ছোট্ট ছেলেটির। নিকোলাসের আর ইতালি দেখা হল না। কিন্তু তার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন সদ্যপ্রয়াত পুত্র বেঁচে থাকুক প্রিয় ইতালিতেই। তবে অন্যভাবে।
হাসপাতালের চিকিৎসকদের তিনি জানান, পুত্রের শরীর দান করতে চান। যাতে ইতালির কয়েকজন অসুস্থ শিশু নিকোলাসের শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ নিয়ে বেঁচে থাকে। শুনে চমকে উঠেছিলেন সকলে। বলা হয়, মরণোত্তর দেহদানের সেই নাকি শুরু।
এক বছর পরে, নিকোলাসের মৃত্যুর দিনে তার বাবা-মা পৌঁছন ইতালির সেই জায়গায়, যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ছোট্ট নিকোলাস। গিয়ে দেখেন অনেক মানুষ সেখানে। রয়েছে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা। নিকোলাসের বাবা-মায়ের পরিচয় জানতে পেরে কয়েকজন ছোট ছেলেমেয়ে এসে জড়িয়ে ধরল তাঁদের। ফুটফুটে মারিয়া বলল, ‘‘আমরা সবাই নিকোলাসের শরীরের অংশ নিয়ে বেঁচে আছি। তাই এখন থেকে আমরা সবাই নিকোলাস।’’
এ ভাবেই রবিবার সকালে নবদ্বীপে ফাঁসিতলায় মরণোত্তর দেহদানের ইতিহাস বলতে গিয়ে গল্পচ্ছলে ঘটনাটা বলছিলেন ‘গণদর্পণের’ শ্যামল চট্টোপাধ্যায়। ডিওয়াইএফআই এ দিন নবদ্বীপে আয়োজন করেছিল এই অনুষ্ঠানের। উৎসবের শহর নবদ্বীপে বারো মাসে তেরো পার্বণ হলেও মরণোত্তর দেহদান ঘিরে এমন আয়োজন এই প্রথম।
দেহদান প্রসঙ্গে মঞ্চে শ্যামলবাবু যখন নিকোলাসের কথা বলছিলেন, তখনই মঞ্চের নিচে হন্তদন্ত হয়ে হাজির ছোটখাটো চেহারার নিতাইচন্দ্র সূত্রধর। তিনি বলেন ‘‘অনেক আগে একবার চোখ দেব বলে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। এবার নবদ্বীপে এমন আয়োজন হচ্ছে শুনে সোজা চলে এসেছি।’’ ছিয়াত্তর বছরের পরিমলবাবু পেশায় কাঠমিস্ত্রি। দেহদানের অঙ্গীকার করা যাবে শুনে এসেছিলেন তিনি। পায়রাডাঙ্গার একাত্তর বছরের প্রাণগোপাল বিশ্বাস কিংবা স্বরূপগঞ্জ থেকে পরিমল সরকার, নবদ্বীপের প্রাক্তন পুরপ্রধান সিপিএমের অমরেন্দ্র নাথ বাগচিও এ দিন মরনোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন। সব মিলিয়ে প্রথম আয়োজনেই নবদ্বীপে দেহদানের অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ৩২। ‘গণদর্পণের’ পক্ষে পুরো বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতে আসা খগেন্দ্র কুমার দত্ত বলেন, “নবদ্বীপে মানুষের এত উৎসাহ দেখে ভাল লাগছে।”