পুলিশের নাকের ডগায় লোটোর রমরমা

আইন ভাঙা এত সহজ, দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। কৃষ্ণনগর-রানাঘাট রাজ্য সড়কের মাঝামাঝি জায়গায় তাহেরপুর বাজার। তার একটি গলিতে পাশাপাশি বেশ কিছু গুমটি দোকান। দরজায় পুরু পর্দা। ভিতরে ঠাসা ভিড়। দোকানির সম্বল একটি কম্পিউটার এবং প্রিন্টার। ঠাসা ভিড়। কোনও মতে দাঁড়াতেই ওই যুবক অনলাইন লটারির (লোটো) টিকিট কিনব কিনা, জানতে চাইলেন।

Advertisement

মনিরুল শেখ

তাহেরপুর শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:৫১
Share:

তাহেরপুরে এক লোটোর দোকানে মগ্ন ব্যবসায়ী। —নিজস্ব চিত্র।

আইন ভাঙা এত সহজ, দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না।

Advertisement

কৃষ্ণনগর-রানাঘাট রাজ্য সড়কের মাঝামাঝি জায়গায় তাহেরপুর বাজার। তার একটি গলিতে পাশাপাশি বেশ কিছু গুমটি দোকান। দরজায় পুরু পর্দা। ভিতরে ঠাসা ভিড়। দোকানির সম্বল একটি কম্পিউটার এবং প্রিন্টার। ঠাসা ভিড়। কোনও মতে দাঁড়াতেই ওই যুবক অনলাইন লটারির (লোটো) টিকিট কিনব কিনা, জানতে চাইলেন। তারপর গোটা চারেক দশ টাকার টিকিট কিনলাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই আইনের চোখে একটা অপরাধ করা হয়ে গেল। কারণ অনলাইন লটারি পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৩ সালের ২১ মে অনলাইন লটারি বা ‘লোটো’ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।

তাহেরপুরের লোটো গুমটিতে অবশ্য তার কোনও ছাপ দেখা গেল না। কম্পিউটারের মনিটরে ০ থেকে ৯, এই দশটি সংখ্যা রয়েছে। ক্রেতারা যে সংখ্যার টিকিট কাটছেন। তারপর মনিটরে ভেসে উঠছে একটা সংখ্যা। টিকিটের সংখ্যার সঙ্গে ওই ‘লাকি’ সংখ্যা মিলে গেলে টিকিটের মূল্যের নয়গুণ টাকা মিলবে। নইলে ফক্কা। তাহেরপুর বাজারের ওই লোটো কাউন্টারে আধ ঘন্টা ধরে বসে থেকেও অবশ্য কোনও বিজেতার দেখা মিলল না। নিন্দুকেরা বলেন, কোন কোন টিকিট বিক্রি হল, তা অনলাইনে লোটোর মালিক দেখতে পান বলেই না-কাটা সংখ্যাটিকে ‘লাকি’ বলে দেখানো হয়। কিন্তু এমন ভাঁওতাবাজির সন্দেহ অনলাইন লটারির আকর্ষণ একটুও কমায়নি।

Advertisement

কেবল তাহেরপুর বাজারের লোটো কাউন্টার নয়। গোটা নদিয়া জেলা জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে লোটোর দোকান। জেলার উত্তরে কালীগঞ্জ থানা এলাকা থেকে দক্ষিণে রানাঘাট, সর্বত্র রমরমিয়ে চলছে লোটো। কালীগঞ্জে তো থানা থেকে মিনিট পাঁচেক পায়ে-হাঁটা দূরত্বে লোটোর গুমটি। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যাঁরা চালাচ্ছেন এই বেআইনি কারবার সেই যুবকদের কারও রয়েছে মোবাইলের দোকান, কেউ বা পেশায় গৃহশিক্ষক। কম সময়ে মোটা টাকা আয়ের লোভে খুলে বসেছেন লোটোর ব্যবসা।

কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকাতেই রয়েছে তিনটি লোটোর দোকান। ডাকঘরের গা ঘেঁষে একটি। বাজারে আরও একটি। কালীগঞ্জ থেকে জাতীয় সড়ক ধরে নাকাশিপাড়ায় এলে দেখা যাবে, মনসা মার্কেট (স্টেশনের পাশে), রেল আবাসনের পাশের সেলুন‌ে, মাঠপাড়ার মোড়ে, শিমুলতলার মোড়ে, তৈবিচারায়, হাসপাতালের কাছে রে‌লগেটের ধারে চলছে লোটোর কারবার। ধুবুলিয়া থানা এলাকার মুক্তমঞ্চের সামনের একটি দোকান‌ে চলছে অনলাইন লটারি ব্যবসা।

লোটো যেন কুটির শিল্পের আকার নিয়েছে শান্তিপুরে। ফুলিয়ার টাউনশিপ এলাকা, কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তন্তুবায় সমবায় সমিতি এলাকা, স্টেশন বাজার, ফুলিয়া স্টেশন রোডে চলছে লোটো ব্যবসা। রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প ও আনুলিয়া এলাকাতে চলছে লোটো।

লোটো কাউন্টার সাধারণত খোলে সকাল ১০টা নাগাদ। বিকেল চারটে থেকে ছ’টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। তারপর চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। সারাক্ষণই কাউন্টারগুলির সামনে থিকথিকে ভিড়। কারা এই ভিড় করেন? নাকাশিপাড়া, ধুবুলিয়া, তাহেরপুর প্রভৃতি জায়গা ঘুরে দেখা গেল, রিক্সা-চালক, ভ্যানওয়ালা, মুদির দোকানদার, টোটোওয়ালা এবং কিছু ক্ষেত্রে বিত্তবান মানুষরাও লোটোর টিকিট কাটতে ব্যস্ত। জেতার নেশায় এক একজন টিকিট কিনতেই থাকেন।

খেলার নেশায় নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরলে সংসারে অশান্তি বাধে। কালীগঞ্জের এক মহিলা জানালেন, স্বামী ভ্যানচালক। তিন ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। কিন্তু বাড়ির কর্তা লোটো খেলে বাড়ি ফেরেন। টাকা চাইতে গেলেই গোলমাল, মারধর। তাহেরপুরের এক মহিলাও বলেন, ‘‘স্বামী টোটো চালান। আয়ের সব টাকা লোটোয় ঢেলে বাড়ি ফিরে অশান্তি বাধাচ্ছে।’’

প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, কিংবা জনবহুল এলাকায়, কোনও লুকোছাপা না করে প্রকাশ্যে চলছে লোটোর দোকান। কিন্তু পুলিশ কিছু করছে না কেন? দিন পাঁচেক আগে নাকাশিপাড়ার বাসিন্দারা এই ব্যাপারে জেলার পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন। তাঁরা আবেদন করেছেন, ‘‘স্থানীয় ওসি লোটোর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। এর প্রতিকার করুন।’’ পুলিশ সুপার ভরতলাল মিনা বলছেন, ‘‘এই বেআইনি কারবার রোধে পদক্ষেপ করা হবে।’’ নাকাশিপাড়া থানার ওসি রাজা সরকার অবশ্য বলেন, ‘‘ কেউ লোটোর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে আসেননি। এলাকায় এ সব চলে কিনা, খোঁজ নিয়ে দেখব।’’ কালীগঞ্জের বিধায়ক তৃণমূলের নাসিরুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে দলীয় সূত্রে লোটোর খবর মিলেছে। খুব দ্রুত এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করব।’’ তাহেরপুর পুরসভার চেয়ারম্যান সিপিএমের রতনরঞ্জন রায় বলেন, ‘‘বছর খানেক আগে দলীয় সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিলাম। সে যাত্রায় এই কারবার বন্ধও হয়ে যায়। আবার চালু হয়েছে। পুলিশকে মৌখিক ভাবে জানিয়েছি। কিন্তু কোনও কাজ হচ্ছে না।’’

একই আক্ষেপ এলাকার মানুষেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন