দে-ওয়াল সেজেছে পসরায়

‘ওয়াল’ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে! পুজোর বাজারে সেই চাপ আরও বেড়ে গিয়েছে। জুকারবার্গের দুনিয়ায় বিষয়ের অভাব নেই। যখন যেমন তখন তেমন। সিঙ্গুরে টাটার শেড ভাঙা, উরিতে নিহত সেনা, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও ব্র্যাড পিটের বিবাহ-বিচ্ছেদ—দেওয়াল জুড়ে অন্তহীন চর্চা।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৩৬
Share:

‘ওয়াল’ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে!

Advertisement

পুজোর বাজারে সেই চাপ আরও বেড়ে গিয়েছে।

জুকারবার্গের দুনিয়ায় বিষয়ের অভাব নেই। যখন যেমন তখন তেমন। সিঙ্গুরে টাটার শেড ভাঙা, উরিতে নিহত সেনা, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও ব্র্যাড পিটের বিবাহ-বিচ্ছেদ—দেওয়াল জুড়ে অন্তহীন চর্চা।

Advertisement

পাশাপাশি জমকালো শাড়ি, টেরাকোটার গয়না, কেতাদুরস্ত ব্যাগের নীচেও গড়াগড়ি খাচ্ছে ‘স্মাইলি’। ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’, ‘শেয়ার’ ক্রমে বেড়েই চলেছে—

—'ei saritar daam kemon porbe?'

—'ph. e ki apnara order nen?'

— ‘বাহ্, কী সুন্দর কাজ করা! :)’

তবে সবটাই কিন্তু ভার্চুয়াল নয়। দিব্যি চলছে বিকিকিনিও। ফেসবুকে পোস্টানো ছবি দেখে ফোন আসছে। কখনও আবার সটান দোকানে হাজির হচ্ছেন ক্রেতা।

বছর কয়েক আগেও পুজোর আগে গাঁ-গঞ্জের দেওয়ালে নতুন রঙের পোঁচ পড়ত। সেখানে লেখা থাকত অমুক বস্ত্রালয় কিংবা তমুক সু হাউস। তারপর দেওয়াল দখল করল খবরের কাগজের ভাঁজে লিফলেট, কেবল। কিন্তু প্রচার কেবল কেবল-লিফলেটেই আটকে না থেকে গ্লোবাল-ভিলেজে পৌঁছে যাচ্ছে।

নদিয়ার এক কেবল ব্যবসায়ী বলছেন, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন টানটান টাওয়ারে পাক খাচ্ছে থ্রিজি-ফোরজি। লোকজন যে তার সুবিধা নেবেন সে তো বলাই বাহুল্য। ’’

গত প্রায় কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে টেরাকোটার গয়না-সহ নানা সামগ্রী তৈরি করছেন নবদ্বীপের তপন রাড়ী। তাঁর তৈরি ‘কাজ’ বহু জায়গায় পুরস্কৃতও হয়েছে। তিনি এ বছর তাঁর তৈরি গয়না ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সঙ্গে দিয়েছেন নিজের ফোন নম্বর।

তপনবাবু জানাচ্ছেন, নবদ্বীপে তাঁর দোকানের স্থান পরিবর্তন হয়েছে। সেটা জানাতে ও পুজোর আগে নতুন তৈরি গয়নার বিজ্ঞাপন দিতেই তাঁর এই উদ্যোগ। তাঁর কথায়, ‘‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা হল। ইতিমধ্যে বহু লোক দোকানে এসে গয়নাও নিয়ে গিয়েছেন।’’

মুর্শিদাবাদের মির্জাপুরের তুহিন মণিগ্রাম জঙ্গিপুর কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবা-কাকারা তাঁত বোনেন। বাড়িতেই শাড়ির কারবার। বছর দু’য়েক আগেই তিনি ফেসবুকে সেই শাড়ির ছবি পোস্ট করে বাজিমাত করে দিয়েছিলেন। শাড়ি বাজারে যাওয়ার আগে বাজারই হাজির হয়েছিল বাড়িতে।

তুহিন বলছেন, ‘‘এটা বিপণনের যুগ। অন্যান্য নামী সংস্থা যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসা করতে পারে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? নেট-মোবাইলের যুগে নিখরচায় এই সুযোগটাকে কাজে লাগালে তো ঘরে বসেই লক্ষ্মীলাভ।’’

কথাটা কথার কথা নয়। শহর থেকে গাঁ-গঞ্জ আটকে পড়েছে অন্তর্জালে। রাতে মোবাইলের ডেটা শেষ হলে ঘুম মাথায় ওঠে জেন ওয়াইয়ের। সকালে উঠে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ‘চেক’ না করে দিন শুরু করতে পারেন না অনেকেই। আর পুজোর মুখে এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

করিমপুরের সুমন সরকার যেমন। ব্যাগের ব্যবসায়ী সুমন মাসে ন’শো টাকা খরচ করে পুজোর আগে স্থানীয় কেবলে দোকানের বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। পাশাপাশি সেই ভিডিও তিনি আপলোড করে দিয়েছেন ফেসবুকেও। সেই সঙ্গে নিত্য নতুন ব্যাগের ছবিও তিনি পোস্ট করছেন। সুমন বলছেন, ‘‘এখন তো প্রায় সকলেই ফেসবুকে মজে আছেন। আমার বন্ধু তালিকায় করিমপুরেরও বহু লোকজন আছেন। তাঁদেরও সেটা চোখে পড়েছে। সাড়াও মিলছে।’’

বাগডাঙার নাজবুল হকের কম্পিউটরের সামগ্রী ও মোবাইলের দোকান রয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি ক্যুরিয়ারেরও কারবার করেন। নাজবুলের স্পষ্ট কথা, ‘‘দেখুন দাদা, ফেসবুকে কেউ কবিতা লেখে, কেউ সেল্ফি পোস্ট করে। আমি দোকানে নতুন কী এল সেটা পোস্ট করি। দোকানে স্থানীয় ক্রেতারাই আসেন। তাঁদের অনেকেই আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন। ফলে নিখরচায় দিব্যি বিজ্ঞাপন হয়ে যায়।’’

সাগরপাড়ার তুহিনা বিশ্বাসের কথায়, ‘‘আমার এক বন্ধু সদ্য শাড়ির ব্যবসা শুরু করেছে। জানতে পারলাম ফেসবুক দেখে। ওর পোস্ট দেখে আমি তো ইতিমধ্যে দু’টো শাড়ির অর্ডারও করে দিয়েছি।’’ বহরমপুরের এক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী তাঁর ফেসবুক পেজে নতুন পদের লিস্টিও দিয়ে দিচ্ছেন।

বহরমপুরে বুটিক চালান সোমা ভদ্র। তিনিও প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককেই বেছে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বহরমপুর তো বটেই, পড়শি এলাকা থেকেও বহু ক্রেতা এখন আমার দোকানে ভিড় করছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার আলাপ হয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে।’’

বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ শৌভিক মিশ্র বলছেন, ‘‘এটা নতুন প্রবণতা তো বটেই। ঘরে বসে সাধারণ মানুষ নিজেই নিজের মতো করে বিজ্ঞাপন দিতে পারছেন। হয়তো খবরের কাগজ বা টিভির মতো বিরাট সংখ্যক লোকের কাছে পৌঁছতে পারছেন না। কিন্তু লাইক, শেয়ার হতে হতে প্রায় নিখরচায় কিছু লোকজনের কাছে তো পৌঁছতে পারছেন। সেটাই বা কম কী!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন