ছাই ঘেঁটে এক ব্যাগ বরাত তুলে এনেছেন কাকলি

আজ এলাকার প্রায় সত্তর জন মানুষের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন কাকলি। মাত্র তেরো বছরেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি আরও অনেকের রুজিরুটি যোগাচ্ছেন তিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তেহট্ট শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৭ ১৩:৩০
Share:

তদারকি: কারখানায় কাকলি।

বছর তেরো আগের কথা। এক দুপুরে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল শেষ সম্বলটুকু। বেঁচে থাকার তাগিদে দিনমজুরের কাজ নিয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়েছিল স্বামীকে। দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে দু’মুঠো ভাতের জন্য জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তেহট্টের নাজিরপুরের কাকলি বিশ্বাসের।

Advertisement

আজ এলাকার প্রায় সত্তর জন মানুষের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন কাকলি। মাত্র তেরো বছরেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি আরও অনেকের রুজিরুটি যোগাচ্ছেন তিনি।

কাকলি জানান, তেহট্টের বড়েয়ায় তাঁর বাপের বাড়ি। অবস্থা স্বচ্ছল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায়। নাজিরপুরে এক চিলতে টিনের ঘরে বাস। স্থানীয় বাজারে স্বামীর ছোট একটি মনোহারি দোকানের উপর নির্ভর করেই সংসার চলত। বললেন, ‘‘২০০৪ সালে এক দুপুরে দেড় বছরের মেয়ে, স্বামীর সঙ্গে ঘুমিয়েছিলাম। আচমকা পড়শিদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বেরিয়ে দেখি পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে। কিছু ক্ষণের মধ্যে সেই আগুনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল আমার সংসার। পরনের কাপড়জামাটুকু ছাড়া আর কিছুই
অবশিষ্ট ছিল না।’’

Advertisement

প্রতিবেশিদের দেওয়া ত্রিপলের ছাউনির নীচে রাত কাটানো। ক’দিন পরে সকলে একটা টিনের ঘর তৈরি করে দেয়। কিন্তু অভাবে পড়ে স্বামীর দোকান বন্ধ হয়ে গেল। রোজগারের আশায় কেরলে চলে যান স্বামী স্বপন বিশ্বাস। পড়শিদের তৈরি করে দেওয়া এক চিলতে ঘরে দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে শুরু হল কাকলির লড়াই।

আরও পড়ুন: ‘খোলসা করে বলি, আমি মনের মানুষ পেয়ে গিয়েছি’

জানালেন, চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারতেন না। কিছু একটা করার ইচ্ছে মাথায় চেপে বসেছিল। এক দিন সকলের কাছে ধার করে একটা পুরনো সেলাই মেশিন কিনলেন। সম্পর্কে মামা ভগীরথ মণ্ডল পরামর্শ দেন, এলাকার বিভিন্ন দোকানে ব্যাগ বানিয়ে সরবরাহ করা যায়।

খুব কষ্ট করে নগদ সতেরোশো টাকা হাতে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন কাকলি। বললেন, ‘‘ব্যাগ তৈরির কিছুই জানতাম না। কয়েকটা পুরনো ব্যাগ বাজার থেকে বাড়ি নিয়ে এসে সেগুলো খুলে ব্যাপারটা দেখলাম। তার পর নিজেও চেষ্টা করলাম। প্রথমে ভাল হত না। কিন্তু কিছু তো করতেই হবে। এই জেদেই রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে সারা রাত জেগে কাজ করতাম।’’

সকাল হলে নিজের তৈরি ব্যাগ নিয়ে বিক্রির জন্য দোকানে দোকানে যেতেন। হাতে নগদ টাকা আসতে ধীরে ধীরে কষ্টের দিনগুলো বদলে যেতে লাগল। দিনে দিনে বাড়তে থাকে ব্যবসা। বাড়ি চলে আসেন স্বামী। দু’টি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে আরও বড় হয় ব্যবসা। প্রতিবেশী কয়েক জন কাজে যুক্ত হন।

এখন কলকাতা থেকে কাঁচা মাল আসে। বাড়ির কারখানায় প্রায় দশ জন সব সময় ব্যাগ তৈরির কাজ করে। তা ছাড়া এলাকার আরও ষাট জন কাকলির জন্য ব্যাগ তৈরি করেন। মহকুমার বিভিন্ন বাজারের বহু দোকানে ব্যাগ সরবরাহ করেন তাঁরা।

‘‘আজ আমার তৃপ্তি একটাই— নিজের অন্ন সংস্থানের পাশাপাশি আরও অনেকের মুখে দু’টো ভাত তুলে দিতে পেরেছি,” বললেন কাকলি।

ব্যবসার পুরো কৃতিত্বটাই স্ত্রীকে দিচ্ছেন স্বপনবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ভেসে যাওয়া সংসারের হাল ধরেছে তো ও-ই। মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। মাধ্যমিক পাশ করল। বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকান বড় হয়েছে। সবই তো ওঁর হাত ধরে।’’

কাকলির কারখানায় কাজ করেন নাজিরপুরের আনেছা বিবি। বললেন, “সংসার সামলে এখানে যা আয় করি, সংসারের কাজে লাগে। নাতি-নাতনির পড়াশোনার খরচ চালাই ওই টাকা দিয়েই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন