টিয়ার খোঁজে শহরে বিজ্ঞাপন। — নিজস্ব চিত্র
খান কয়েক পুরনো ছোলা আর উপুড় করা জলের বাটিটা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করছে খাঁচাটা।
যাও পাখি বলো/ হাওয়া ছলছল/ আবছায়া জানলার কাচ।
খাঁচার গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে মেয়েটি বলছে—
জানেন, আগে কতবার খাঁচাটা খোলা পড়েই থেকেছে। কখনো উড়ে যায়নি মিঠু।
সেই গাঢ সবুজ টিয়াটা আস্ত বাড়িটাই ফাঁকা করে এ ভাবে উড়ে গেল কেন? মনখারাপের সিপিয়া রং নিয়ে এই অলুক্ষনে প্রশ্নটা বিনবিন করছে বিশ্বাস বাড়িতে।
সেই হা হুতাশটা ডানা ঝাপটে যেন ছড়িয়ে পড়েছে আস্ত শহরটায়। কৃষ্ণনগরের আটপৌরে সেই দোতলার ফ্ল্যাট উজিয়ে নাজিরা পাড়া, কুর্চিপোতা ছাডিয়ে পোস্ট অফিস মোড়— সেই মনখারাপ ছড়িয়ে রয়েছে দেওয়ালে। সাদা কাগজে বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ে ফটো অফসেট জ্বলজ্বল করছে— একটা টিয়া পাখি গত ৭ ফেব্রুয়ারি পাত্রবাজার থেকে উড়ে গিয়েছে। কেউ পেয়ে থাকলে বা ফেরত দিলে পাঁচ হাজার টাকা নগদ পুরস্কার দেওয়া হবে। ফুটনোট বলছে: টিয়া পাখিটি মা মা, মিঠু মিঠু বলে ডাকত। সঙ্গে পাঁচ-পাঁচখানা ফোন নম্বর। দিন যায়, ঘুরতে চলল মাস। মিঠু আর ফেরেনি।
দরজা খোলার শব্দ পেলেই চিৎকার করে যে পাড়া মাথায় করত, সে এমন কোল খালি করে উড়ে গেল কেন বলুন তো? নিজের মনেই প্রশ্ন করছেন চন্দনবাবু। ব্যাঙ্ককর্মী ভদ্রলোকের স্বচ্ছল সংসারে, স্ত্রী আর দুই মেয়ের সঙ্গে মিঠুও যে সন্তানসম, বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে তাঁর। বলছেন, ‘‘জানেন, এখনও ওর জন্য বাজার থেকে আপেল, তরমুজ এনে রাখি। যদি মনে পড়ে, যদি ফিরে আসে।’’ গলা ধরে আসে তাঁর।
টিয়ার শূন্য খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে চন্দনবাবুর বড়মেয়ে প্রিয়দর্শিনী। সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
আদি বাড়ি হাঁসখালির বগুলায়। বলছেন, ‘‘এই ফ্ল্যাটে এসেছি বছর দুয়েক। মিঠুও সেই থেকে। আর তো ক’টা দিন। কলকাতায় বদলি হয়ে যাচ্ছি। মিঠুকে ছেড়ে যাব কী করে বলুন তো, খালি মনে হয়, যদি ফিরে এসে দেখে আমরা নেই!’’
তাঁর স্ত্রী মিনাক্ষী বলছেন, ‘‘ছোট থেকে পাখি, খরগোশ পোষার শখ ওঁর। গত বছর জানুয়ারিতে বেলডাঙ্গা হাট থেকে দেড় মাসের টিয়া-ছানাটা নিয়ে এল। তখনও গায়ে পালক গজায়নি। রাত জেগে পাখিটাকে বড় করল, জানেন। সেই পাখি কিনা উড়ে গেল। আচ্ছা পাখিদের মন হয় না?’’
খাঁচা থেকে বের করে ছেড়ে দিলে ঘরের চৌহদ্দিতেই ঘুরঘুর করত যে পাখি সে উড়ে গেল কেন?
সে দিন সপিরাবের বাজারে গিয়েছিল বিশ্বাস পরিবার। ঘন্টাদেড়েক পরে ফিরে দেখেন বাড়ির খোলা বারান্দায় খাঁচা রয়েছে, পাখি নেই। পাশে পড়ে রয়েছে পাশাপাশি মিঠুর পছন্দের আপেল-ভুট্টার টুকরো। দিনভর খুঁজেও পাওয়া য়ায়নি তাকে। কেউ ধরে নিয়ে যায়নি তো, ভাম বা অন্য কোনও বড় পাখি? দু-হাতে মুখ ঢেকে চন্দনবাবু বলছেন, ‘‘ভাবতেও পারছি না, এ সব অলুক্ষণে কথা বলবেন না!’’
রেডিওয় তখনও বাজছে—যাও পাখি বলো/ হাওয়া ছলছল/ আবছায়া জানলার কাচ।