নদী ভাঙন নিয়ে শঙ্কায় পদ্মার চরের বাসিন্দারা। —ফাইল চিত্র
পদ্মার কোলে ঘর বেঁধেছে বাবুই। বুনো কুল আর তেঁতুল গাছগুলো তাদের নিপুণ ঠাসবুনোট বাসায় একেবারে অন্য চেহারা নিয়েছে।
‘‘বাবুইয়ের বাসা দ্যাখতিছেন? বৎসর বৎসর অমন যত্ন করি ঘর তো চরের মাইনষেও বানায়। কিন্তু পদ্মা যে গিলে খায়। সেই দিন আসত্যাসে!’’
বিএসএফ ক্যাম্পে ভোটার কার্ড জমা রেখে রোশন আলি তাঁর খেটো লুঙ্গিটা দু’ভাঁজ করে পদ্মায় মাছ ধরতে ভেসে পড়েন। নদীতে এখন খোকা ইলিশ আর গলদা চিংড়ির উচ্ছল হুটোপুটি। নদী জাগছে। রোশন জানেন, নদী জাগলে এ বারও ঘর বাঁধতে হবে। তার আগে চিংড়ি-ইলিশে চাট্টি বাড়তি আয় তুলে রাখতে দিনভর পদ্মার জলে ডিঙি নিয়ে ভেসে আছেন রোশন। রাতেও কি ঘুম আছে?
মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা ব্লকে বিস্তীর্ণ পদ্মার বুকে ‘চরজাগানিয়া’ গান গেয়ে এখন রাত জাগছে নির্মলচর। চরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা মহিষমারি, আলেখপাড়া, শয়তানপাড়ার মানুষ লণ্ঠন হাতে নদীর কিনারে ঘুরে বেড়ান। বর্ষায় ভরা নদী ‘ডাক’ দিচ্ছে বুঝলেই হাঁক পাড়েন, ‘নদী জাগছে গো-ও-ও!’ নদীর হাওয়া ডাকহরকরা হয়ে সেই বার্তা ছড়িয়ে দেয় গ্রাম থেকে পড়শি গ্রামে।
নির্মলচরে খান এগারো গ্রাম। টিপটিপ, ঝরঝর বৃষ্টি মাথায় করে নদীর ভাবগতিক মাপছেন সেই সব গ্রামের মানুষ। পাঁচ সেলের টর্চ জ্বেলে মাঝে মাঝে দেখে নেন নদীর হিংস্রতা। রোশন বলেন, ‘‘বেশি টর্চ জ্বাললিও সমস্যা। বিএসএফ তাড়া করবি যে!’’
নদী ডাকলেও নির্মলচরের ভরসা ফ্লাড শেল্টার সেই কবেই বেহাত হয়ে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে তার ঠিকানা, ‘মহিষমারি বিওপি’। পদ্মার কোলে সেই তিনতলা বাড়িটা দখল নিয়েছে বিএসএফের নয়া ব্যাটেলিয়ান। সাঁঝ নামতেই সেখানে আঁধার চরে তারা ফোটার মতো জ্বলে ওঠে ডুমো আলো, ভটভট করে চলতে থাকে জেনারেটর। জেনারেটরের ঘড়ঘড় শব্দ হারিয়ে যায় পদ্মার গর্জনে। শেষ বিকেলে বিদ্যুতের আলো দেখতে ক্যাম্পের কিনারে ভিড় করে চরের কিশোরকুল। বিস্ময়ে হাঁ-মুখ, ওরা পরস্পরকে শুধোয়, ‘‘আমাগো গাঁয়ে অমন ডুমো আলো কবে জ্বলবা রে!’’
পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বেলে মাটি ঝরিয়ে বছর পনেরোর জালাল শেখ রাগে গর গর করে। জালালের মতোই বিএসএফ নিয়ে বীতশ্রদ্ধ চরের বাসিন্দারা, ‘‘যত রাগ আমাগো উপর, আর বাংলাদেশিরা যে ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে!’’
ঢের বয়স হয়েছে মনসুর আলির। বলছেন, “পদ্মার রাঙা চোখ অনেক দ্যাখছি। আবার সোনা জমিতে সে ফলনও দিয়েছে ঢের। কিন্তু বিএসএফের কাছে তো শুধুই বেয়নেটের খোঁচা!”
চরের রাজনীতিতে দল বদলে পরিচিত মুখ তৃণমূলের অমিনুল আলি, বলছেন, ‘‘আবাদের জন্য ভগবানগোলা হাট থেকে এক জোড়া মোষ কিনলে তা গ্রামে আনতে তিন তিনটে থানার কাছে ‘দাসখত’ লিখে দিতে হয়, চোরাচালান নয়, এ মোষ আবাদের জন্য। পুলিশের ছাড়পত্র নিয়ে নাও ভাসিয়ে গবাদি পশু চরে আনার পরে শুরু হয় বিএসএফের ‘অত্যাচার’। কোথাকার মোষ, চরে কেন এল—সন্তুষ্ট না হলে মোষই কেড়ে নেবে।”