হারানো গরম-১: ছোটরা এক সময় ছড়া কাটত, ‘তালের পাখা প্রাণের সখা, গরমকালে হয় যে দেখা’

ইনভার্টারের ধাক্কায় পাখার বাতাস ভুলতে বসেছে গৃহস্থ

বাড়ির কর্তা হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন ঘরের মেঝেতে। আর কেদারায় বসে বাড়ির চাকর উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে চলেছে কী ভাবে কর্তাবাবুর স্মার্ট, হ্যান্ডসাম ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে গিন্নিমা সেজেগুজে বেড়াতে গেলেন।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৭ ০১:৩৫
Share:

বাতাস: হাতপাখা ফেরি। —নিজস্ব চিত্র।

বাড়ির কর্তা হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন ঘরের মেঝেতে। আর কেদারায় বসে বাড়ির চাকর উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে চলেছে কী ভাবে কর্তাবাবুর স্মার্ট, হ্যান্ডসাম ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে গিন্নিমা সেজেগুজে বেড়াতে গেলেন। শুনতে-শুনতে হতবাক কর্তাবাবু চাকরকে থেকে-থেকে বলে উঠছেন— “বাতাসটা কর। বাতাসটা করে যা।”

Advertisement

ওমনি চাকর প্রকাণ্ড এক তালপাতার হাতপাখা নেড়ে কর্তাবাবুর গায়েমাথায় হাওয়া দিচ্ছে। ‘দম্পতি’ নাটকে কর্তার ভুমিকায় নাট্যকার মনোজ মিত্রের বলা অনবদ্য ওই সংলাপ ‘বাতাসটা কর’ এক সময় মুখে মুখে ঘুরত।

বাংলা নাটক বা সিনেমার এমন হাতপাখার ব্যবহার আকছার দেখেছে মানুষ। গরমের পাখা, বর্ষার ছাতা আর শীতের কাঁথা বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল পরতে পরতে। আইঢাই গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে তালপাতার পাখার কোনও বিকল্প ছিল না। ছোটরা ছড়া কাটত ‘তালের পাখা প্রাণের সখা, গরমকালে হয় যে দেখা’। গরমের দুপুরে বাড়ির দাওয়ায় মেয়েলি আড্ডা
থেকে বাগানের আমমাচায় বয়স্কদের মজলিস কিংবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশায়ের হাতে কিছু দিন আগেও তালপাখার বিচরণ ছিল অবাধ।

Advertisement

সময়টা ১৯৬৭-৬৮ হবে। নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় বাবার পাখার দোকানে গরমের ছুটির সময় বসত স্কুল পড়ুয়া শিবু। একটা পাখা বিক্রি করে খদ্দেরদের কাছ থেকে দশ পয়সা দাম নিতে বলতেন বাবা। সেই স্কুল পড়ুয়া বালক এখন নবদ্বীপ পোড়ামাতলার একমাত্র হাতপাখা বিক্রেতা শিবশঙ্কর সাহা। বলছিলেন, সে সময় বিদ্যুৎ এলেও লোকের বাড়িতে বড় জোর শোওয়ার ঘরে সিলিং ফ্যান থাকত। ফলে বাকি সময়ের ভরসা বলতে ওই হাতপাখা।

তিনি বলেন, “এমনও দিন গিয়েছে দৈনিক কয়েকশো হাতপাখা বিক্রি হয়েছে। বহু দোকানে পাখা বিক্রি হত। তার পর ঘরে ঘরে জেনারেটর, ইনভার্টার এল। কমে গেল লোডশেডিং। মানুষ হাতপাখার ব্যবহার ভুলে গেল।”

বহরমপুর গোপালঘাটের পাখা বিক্রেতা নন্দকিশোর দে কিংবা করিমপুর হসপিটাল রোডের দোকানদারের পীযূষকান্তি নাথের মুখেও সেই একই কথা। তাঁরা জানান পাঁচ’ছ বছরের মধ্যে হঠাৎ করেই যেন হাতপাখার বিক্রি একেবারে কমে গেল। গোটা মরশুমে দেড়শো থেকে দু’শো হাতপাখা বিক্রি হয়। পীযূষকান্তি বাবু মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়া, দু’জেলা থেকেই পাইকারি কেনেন হাতপাখা। দশ থেকে পনেরো টাকার মধ্যে সাইজ অনুযায়ী বিক্রি করেন। নবদ্বীপ বাজারে অবশ্য পাখার একই দাম দশ টাকা। ক্রেতাদের বেশির ভাগই গ্রামীণ মানুষ। ঘুমের সময় ছাড়া দিনের বাকি সময়ে যাঁদের এখনও প্রয়োজন হয় হাতপাখার। শিকারপুরের পঞ্চানন বিশ্বাস যেমন বলেন, “সকাল বিকেল বাগানের আম পাহারা দেওয়ার জন্য মাচায় বসলে হাতপাখা ছাড়া হাওয়া খাওয়ার আর উপায় কোথায়?”

সাধারণত ফাল্গুন মাস থেকে শুরু হয় হাতপাখার মরশুম। চৈত্র থেকে ভাদ্র হল পাখা তৈরি এবং বিক্রির সময়। নদিয়ার ধুবিনাগাদি, গাছা, দেবগ্রাম, মুড়াগাছা, ধুবুলিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে তৈরি হয় তালপাতার পাখা। নদিয়ার কারিগর পরিমল সরকার বলেন, “এখনও হাতপাখার চাহিদা একেবারে নেই বললে ভুল বলা হবে। তবে কমছে। তার থেকেও দ্রুত কমছে কারিগর এবং তালগাছ।” তার কথায় নতুন করে কারিগর মিলছে না। পুরানো যাঁরা আছেন, তাঁদের পরের প্রজন্ম আর এ কাজে আসছে না। আরও কয়েক বছর পরে পাখা তৈরি করার ভাল কারিগর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একই ভাবে সংখ্যায় কমছে তালগাছও।

গ্রামীণ ব্রতকথায় কিংবা জামাইষষ্টিতে জামাইকে ‘ষাটের বাতাস’ করতে তালপাতার পাখা চাইই। তবে শহরের ক্রেতারা আর ও-সব মানেন না। প্লাস্টিকের সস্তা হাতপাখাতেই কাজ সারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন