অনেকেই যেন কান দিয়ে দেখতে ভালবাসে। আবার অনেকের ধারণা, ইন্টারনেট-বাহিত হয়ে যা কিছু আসে, সবই ঠিক।
হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ধ্রুব সত্যি, ফেসবুক তো বেদ-কোরান!
অনেকের আবার সে সবও লাগে না। উদ্ভট গপ্পো একটা আঁকড়ে ধরতে পারলেই ভরা আমোদ। সে রানিনগরে ছেলেধরা পাকড়াও হোক বা ঘূর্ণিতে আগুনের গোলা। গুজবের তিল থেকে তাল হতে কতক্ষণ?
সে বার জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কৃষ্ণনগরের তাপমাত্রা ছ’সাত ডিগ্রির আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। রাস্তা-ঘাটে চায়ের দোকানে সবাই প্রায় নিশ্চিত, এমন ঠান্ডা বহুকাল পড়েনি (আবহাওয়া দফতরের খাতা কী বলে তাতে কার কী এসে-যায়)।
সালটা ছিল ২০০৪। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়াতেই বদলে গেল আলোচনা। শহর সরগরম হয়ে উঠল ‘ফায়ারম্যান’-এর চর্চায়। এক-এক রাতে, কখনও-কখনও এমনকী দিনের বেলাতেও বাড়ির মধ্যে ছুটে আসছে আগুনের গোলা। আতঙ্কে রাত ৮টা বাজতে না বাজতেই পথঘাট সুনসান। কে ঝুঁকি নেবে!
সে বছর ৬ জানুয়ারি রাতে ঘূর্ণিতে একটি বাড়ির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে ঘুলঘুলি দিয়ে আগুনের গোলা ছুড়ে দিয়েছিল কেউ। বাড়ির একাংশ পুড়ে যায়। দু’দিন পরে ওই এলাকায় আরও একটি বাড়িতে আগুন লাগে। পরের দিন আরও একটি বাড়িতে। তার পরের চার দিনে অন্তত পাঁচটি বাড়িতে আগুন। কয়েকটি বাড়িতে পাওয়া যায় কেরোসিন মাখানো কাপড়ের আধপোড়া গোলা।
কে ছুড়ছে আগুনের গোলা? কে আবার— ফায়ারম্যান! ১৯৮৯ সালে কলকাতায় একের পর এক পথবাসী মানুষের মাথা পাথরে থেঁতলে খুনের ঘটনায় অজানা আততায়ীর কাগুজে নাম হয়েছিল ‘স্টোনম্যান’। কৃষ্ণনগরে এসে তা-ই হয়ে গেল ‘ফায়ারম্যান’।
‘স্টোনম্যান’ আজও ধরা পড়েনি, ‘ফায়ারম্যান’ও নয়। রহস্যটা রহস্যই রয়ে গিয়েছে আর রয়েছে তাকে ঘিরে ফেনিয়ে ওঠা গপ্পোগুজব। শেষমেশ পুলিশ জানিয়ে দেয়, যার বাড়িতে আগুন লাগবে, তাকে আগে পাকড়াও করা হবে। ‘ফায়ার’ জলে যায়!
বছর দুই আগে আবার ছেলেধরা নিয়ে সরগরম ইসলামপুর, জঙ্গিপুর, লালবাগ, রানিনগর থেকে সীমান্ত ঘেঁষা ডোমকল। কারা যেন ইয়া বড় ঝোলা নিয়ে তল্লাটে আসছে-যাচ্ছে আর কচি ছেলেমেয়ে দেখলেই টপ করে পুরে নিচ্ছে। কাজেই সে রকম ঝোলা কাঁধে ফেরিওয়ালা, ভবঘুরে, এমনকী মানসিক ভারসাম্যহীন লোক দেখলেই জনতা মারমুখী। আতঙ্কেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় কিছু স্কুলে। কিছু স্কুলে দোর খোলা থাকলেও পড়ুয়াদের হাজিরা তলানিতে।
এক দুপুরে রানিনগর বাজারের প্রাথমিক স্কুল থেকে তিন পড়ুয়াকে ছেলেধরা তুলে নিয়ে গিয়েছে বলে গুজব ছড়ায়। নিমেষে ভিড় জমে যায়। অভিভাবক থেকে সাধারণ মানুষ। ছুটে আসে পুলিশ। কার ছেলেমেয়ে খোয়া গেল? কেউ জানে না! কিন্তু গুজব ছড়াতে থাকে হাওয়ার বেগে জলঙ্গি থেকে ইসলামপুর। জলঙ্গিতে ঝোলা কাধে সাধুকে ধরে পিটিয়ে দেয় লোকে। ওই এলাকারই পোল্লাডাঙায় প্রাথমিক স্কুলে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক এসে হাজির হওয়ায় রণক্ষেত্র বেধে যায়। জলঙ্গির বিডিও যুবককে উদ্ধার করতে এসে ইটবৃষ্টিতে জখম হন। জখম হয় পুলিশও।
এ বারের হবিবপুর মনে পড়ে যাচ্ছে? নাকি কালনা? না, চাপড়া? সে বারও অচেনা কাউকে দেখলেই করা হচ্ছিল হেনস্থা। কুচিয়ামোড়ায় এক মহিলাকে জানে মারারও চেষ্টা হয়। যেমন এ বার কাজের খোঁজে গিয়ে গণপ্রহারে মারা গিয়েছেন এক জন। তার জেরে রণক্ষেত্র হয়েছে হবিবপুর। আক্রমণ থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন ও ভবঘুরেদের বাঁচাতে ঠাঁই দিতে হয়েছে থানায়।
এ বার বল গড়াতে শুরু করেছিল বড়দিনের সময় থেকে। ২৫ ডিসেম্বর কল্যাণী শহর লাগোয়া একটি আশ্রমে হাজার দশেক টাকা ডাকাতি হয়। পরের এক সপ্তাহে আশপাশে আরও চারটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সব ক্ষেত্রেই ডাকাতেরা দলে ছিল ছ’জন। মুখ ঢাকা। হাতে শাবল, স্ক্রু-ড্রাইভার। পুলিশের সন্দেহ, গুজবের জমি তৈরি করার জন্যই ওই ডাকাতি সাজানো হয়ে থাকতে পারে। কোনও ক্ষেত্রেই টাকার অঙ্ক বড় নয়। প্রতি ক্ষেত্রেই হয়েছে নির্জন এলাকায়। যেখানে দুষ্কৃতীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ার সম্ভাবনা কম। এর পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াতে শুরু করে ডাকাতি-ছেলেধরা-ধর্ষণের গুজব। পুলিশের অনুমান, সামাজিক স্থিতি নষ্ট করার অভিসন্ধি নিয়েই গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
কিন্তু গুজবের গতি আটকাতে পুলিশ-প্রশাসন কী করছে? বিভিন্ন দলের নেতারাই বা কী করছেন?