বাঙ্কে লঙ্কার বস্তা। — নিজস্ব চিত্র
হুড়মুড়িয়ে বস্তা এসে পড়ল ট্রেনের কামরায়। তীব্র ঝাঁঝ।
—যাত্রী কামরায় লঙ্কা ওঠাচ্ছেন কেন? দেখছেন না, বাচ্চাটা ঝাঁঝে বসতে পারছে না!
বেশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মহিলা। কেউই অবশ্য উত্তর দিচ্ছিল না। যাদের উদ্দেশে বলা তারা তখন সিটের নীচে আর উপরের বাঙ্কে বস্তা গুঁজতে ব্যস্ত।
হাতের কাজ সারা হতেই কোমরে শাড়ির আঁচল বেঁধে ঘুরে দাঁড়ালেন তিন মহিলা। পানে রাঙা টুকটুকে ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল থেকেও লঙ্কার চেয়েও ঝাঁঝালো সংলাপ— ‘‘খুব অসুবিধি হলে পাচ্ছোনাল কারে চাইপা যাবেন, লালগুলা প্যাচেনজারে কেন? আমরাও টিকিট কাইটা টেরেনে উঠ্যাছি। মালের জন্যে পয়সা দিতি হয়, এমলি লয়।’’ বছর চারেকের মেয়ে মামনিকে নিয়ে লালগোলা থেকে ট্রেনে চড়া কল্যাণী মণ্ডল আর কথা বাড়াতে পারেননি। এক দিকে মেয়ের কান্না, অন্য দিকে তিন মহিলার কথামৃতে অস্থির হয়ে পিরতলা স্টেশনে এসেই কামরা বদলে নেন কল্যাণী।
এ ছবি এক দিনের নয়।
লালগোলা প্যাসেঞ্জারের যাত্রীদের নিত্য দিন এ ভাবেই পাড়ি দিতে হয় বহরমপুর, কৃষ্ণনগর বা কলকাতা। কামরা জুড়ে কখনও সব্জির ঝুড়ি, কখনও লঙ্কার বস্তা। কখনও ছানার জলে মাখামাখি মেঝে। ডোমকলের রাজু মণ্ডলের কথায়, ‘‘ঝুড়ি টপকে শৌচাগারে যেতে গিয়ে প্রায় দিনই সব্জিওয়ালাদের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধে আমাদের। ওরা একজোট হয়ে থাকে বলে কিছু হলেই সকলে মিলে হামলে পড়ে।’’ একই অভিজ্ঞতা দেবগ্রামের তনুশ্রী বসুরও। তাঁর খেদ, ‘‘কাউকে বলেও কোনও ফল হয়নি।’’
মাসখানেক আগে স্ত্রীকে নিয়ে এনআরএস হাসপাতালে যাচ্ছিলেন লালগোলার সামসুল মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘পায়ের নীচে, মাথার উপরে লঙ্কার বস্তা। ঝাঁজে আমার অসুস্থ স্ত্রী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রতিবাদ করায় কয়েক জন পুরষ-মহিলা এসে নানা কথা শুনিয়ে দিল।’’ দেবগ্রামের রঞ্জিত সূত্রধরের দাবি, ‘‘অনেক দিন রেলপুলিশকে (জিআরপি) বলেছি, কিন্তু সুরাহা হয়নি। এক বার কামরায় যাওয়ার দরকারও মনে করে না তারা, ‘লিখিত অভিযোগ করুন’ বলেই দায় সারে।’’ বহরমপুর জিআরপি-র ওসি উৎপল বিশ্বাস অবশ্য যথারীতি দাবি করেছেন, ‘‘আমরা দেখতে পেলেই ব্যবস্থা নিই। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তে সুবিধা হয়।’’ রেলপুলিশের একাংশের যোগসাজসে এ সব চলছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে বহু যাত্রীর, তা-ও তিনি অস্বীকার করেছেন।
যাদের নিয়ে এই লঙ্কাকাণ্ড, তাঁরা কী বলছেন? লালগোলার সব্জিওয়ালি কমলা দাস বলেন, ‘‘ভেন্ডারে জায়গা নেই, তাই এমনি কামরায় বস্তা তুলতে বাধ্য হই। প্রতি দিন লোকের সঙ্গে ঝামেলা করতে আমাদেরও ভাল লাগে না। কিন্তু কী করব? স্বামী নেশা করে পড়ে থাকে, শিয়ালদহে বস্তা পৌঁছলে তবেই নুন-ভাত জুটবে।’’
বেঙ্গল রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পুণ্ডরীকাক্ষ কীর্তনিয়ার অভিযোগ, ‘‘লালগোলা প্যাসেঞ্জারের মধ্যে শুধু ১০৮ ডাউন ট্রেন ছাড়া এই লাইনের সব ট্রেনে লঙ্কা, সব্জি, ছানা যাত্রী কামরায় যায়। ভাগীরথী, হাজারদুয়ারি বা ধনধান্য এক্সপ্রেসেও এক সমস্যা। আমরা অনেক বার বিষয়টি শিয়ালদহ বিভাগের ডিআরএমকে লিখিত ভাবে জানিয়েছি। মালবাহী ভেন্ডার কামরায় জায়গা বাড়ানোর আবেদনও করেছি। ফল হয়নি।’’ শিয়ালদহের ডিআরএম বাসুদেব পাণ্ডাকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও উত্তর দেননি।