জল থৈ থৈ মাঠে চলছে খেলা। করিমপুরে। — ফাইল চিত্র
ছিল মাঠ, হয়ে গেল নদী!
ওই যে দূরের গোলপোস্ট, মাথাটুকু উঁচিয়ে। ওটা দেখলেই চেনা যায়, এলাকার খেলার মাঠটা এখানেই।
আসলে আকাশভাঙা বর্ষায় সে বার ঘোলা জল বুকে নিয়ে নদী হয়ে গিয়েছিল নবদ্বীপের সব মাঠ। গঙ্গা আর জলঙ্গির কূল ছাপানো জলে ধুয়ে মুছে একাকার সে মাঠের সীমানা। বানভাসি সেই প্রান্তরে আবাল্য চেনা মানুষও ঠিক ঠাহর পায় না, কোথায় মাঠের শেষ আর নদীর শুরু।
বরং দূরের গোলপোস্টটাকে নিশানা করে মাঝমাঠ বরাবর কোনাকুনি নৌকা বেয়ে পানীয় জল নিতে আসতেন মাঠপারের বাসিন্দারা। আর সে সঙ্গেই চলতো দেদার মাছ ধরা। কে বলে মাঠ? মাঠ যে তখন পুকুর। বন্যার জল চলে যাওয়ার দিন পনেরো পরে মাছশিকারিদের আরও মজা। বুকসমান জল মাঠে। এক দিকে জেগে উঠেছে বড়রাস্তা। তারই পাশে সার বেঁধে ছিপ নিয়ে বসে পড়েছেন এলাকার মানুষ।
সকার কাপের মরসুমে এই মাঠেই দাপিয়ে বেড়ায় বাইশ জোড়া বুট। শীতে এখানেই চলে বইমেলা। বর্ষায় সে সব চেনা দায়।
২০১৫ সালে বন্যায় ভেসে যাওয়া শহরের বিভিন্ন ফুটবল মাঠে এমনই বিচিত্র সব জলছবি দেখেছিল নবদ্বীপের মানুষ। শহরের মধ্যঞ্চলে নির্ভীক সমিতির মাঠ, দক্ষিনে নবদ্বীপ কর্মমন্দির ক্লাবের মাঠ, নদিয়া ক্লাবের মাঠ — সব এক অবস্থা।
রানাঘাট থেকে কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়ার একাংশ, কৃষ্ণনগর ২ ব্লকের বেশির ভাগ এলাকাতে বর্ষার চেনা ছবি এটাই।
করিমপুরে বন্যা তুলনায় কম হয়। তবু বৃষ্টি মানেই জল থৈ থৈ খেলার মাঠ। করিমপুরের রামকৃষ্ণপল্লির যুবক আশিস প্রামাণিকের কথায়, “টানা বৃষ্টিতে খেলার মাঠ জলে ভরে যায়। কিন্তু সেই মাঠেই ফুটবল খেলতে নামি আমরা। কয়েক ঘণ্টা জলে ভিজে খেলার পর স্নান সেরে বাড়ি ফেরা। সে খেলার মজাই আলাদা।”
বর্ষার মরসুমে এক দশা কান্দি, খড়গ্রাম, বেলডাঙা, লালগোলা কিংবা ডোমকলের। এক পশলা বৃষ্টি হল কি হল না, জলকাদায় বিশ্রি অবস্থা। গোলরক্ষক বাদ দিলে ২০ জন খেলোয়াড় জল ঠেলে বল কাড়তে ব্যস্ত। বল আর জলে লাথি পড়ে নাজেহাল অবস্থা রেফারির। শেষে ফুরুত করে বাঁশি বাজিয়ে খেলাটাই বন্ধ করে দিলেন তিনি। অমনি, গ্রামের দর্শক লুঙ্গি গুটিয়ে হইহই করে নেমে পড়লেন মাঠে। তাঁদের দাবি, যতই জল জমুক, যতই বল ভেসে যাক, খেলা চালাতেই হবে। অন্য দিকে, পিছিয়ে থাকা গ্রামের দাবি, ফিফা বলে একটা বস্তু আছে। তার কিছু নিয়মকানুন আছে। সেটা তো মানতে হবে নাকি? বেচারা রেফারির অবস্থা কাকভেজা। ইতিমধ্যেই অতি উৎসাহী দর্শকের ভিড়ে কয়েকটা কিল ঘুষিও খেয়ে ফেলেছেন তিনি।
ডোমকলের কুপিলা গ্রামের খেলোয়াড় মহফুজুর রহমানের দাবি, ‘‘বর্ষার মাঠে খেলারও একটা অন্য রকমের মজা আছে। দুড়দাড় পড়া, ফের কাদা মেখে উঠে বলের পিছনে দৌড়, আবার তাল সামলাতে না পেরে বিপক্ষের খেলয়াড়কে জড়িয়ে ধরা। তা ছাড়া কাদা-জলের মাঠে বল কাড়াকাড়ির দৃশ্যটাও বেশ মজার।’’ যদিও এলাকার প্রবীণ খেলোয়াড় ওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘ভাল মাঠের অভাবে আমাদের এলাকার খেলার মান নেমে যাচ্ছে। একটা সময় গ্রামের মানুষের উদ্যোগে কেনা মাঠ পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’’
বর্ষার মরশুমে ডোমকল মহকুমার অনেক মাঠেই এমন অবস্থা হয়েছে ফুটবলকে ঘিরে। আর এই অবস্থার জন্য আয়োজক কর্তারাও সরাসরি দায়ী করছে মাঠকেই। তাদের দাবি, পঞ্চায়েতের হাতে অনেক ক্ষমতা। মাটি কেটে পুকুর হচ্ছে, আবার সেই পুকুর বুজিয়ে টাকা নয়ছয় হচ্ছে। অথচ খেলার মাঠগুলির দিকে ফিরেও তাকায় না কেউ। বেশ কিছু মাঠ আছে, একটু সংস্কার করলেই বর্ষাতেও খেলার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।