প্রতীকী ছবি।
ঐতিহ্যের দোহাই ও আইনের ফাঁক —কোনও কিছু দিয়েই অবস্থান থেকে নড়ানো গেল না পুলিশ প্রশাসনকে। করোনা আবহে নবদ্বীপের রাসে ঢাক ছাড়া অন্য বাজনা হবে না, এই অবস্থানেই অনড় থাকলেন জেলা পুলিশের কর্তারা। বরং অতিমারির কালে নবদ্বীপের আসন্ন রাস উৎসব কী ভাবে পালন করা হবে, তা নিয়ে পুলিশের তরফে ডাকা সমন্বয় সভার মঞ্চ থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হল, প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিন্ন মত থাকতেই পারে, কিন্তু সেই মতের বাইরে যারা অন্য কিছু ভাবছেন, তাঁরা চাইলে বিষয়টি আদলতকে জানাতে পারেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত যদি কোনও নির্দেশ দেয় প্রশাসন সেই মতো রাস পালন করবে। অন্যথায় রাস নিয়ে পূর্বঘোষিত অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে।
এ বার করোনা আবহে দুর্গা পুজোর পরে নবদ্বীপের রাস নিয়ন্ত্রণে আসরে নামে পুলিশ প্রশাসন। ২৯ অক্টোবর কেন্দ্রীয় রাস উৎসব কমিটির ডাকা সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে রাস উদযাপনে কিছু নির্দেশিকা জারি করা হয়। এক, রাসের আড়ংয়ের শোভাযাত্রা স্থগিত। দুই, নবমীর শোভাযাত্রা বাতিল। তিন, ঢাক ছাড়া অন্য কোনও বাজনা রাসে হবে না। সর্বোচ্চ ঢাকের সংখ্যা ছয়। চার, স্থগিত পুরসভা পরিচালিত রাস কার্নিভাল। এই নির্দেশিকা জারি হতেই শোরগোল পড়ে যায়। অন্য সব কিছু মানতে রাজি হলেও শহরের রাস বারোয়ারির অনেকেই উৎসবে বাজনা বন্ধের সিদ্ধান্তে প্রবল ক্ষুব্ধ হন। শুরু হয় চাপান-উতোর। ইতিমধ্যে নবদ্বীপে রাধাকুণ্ডের স্নান এবং আগমেশ্বরী কালীপুজোয় ভিড় নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ বার্তা দিতে শুরু করে। করোনা পরিস্থিতিতে বাজনা নিয়ে বিনা অনুমতিতে মিছিল করায় পুলিশ বিজেপির বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করে। এই পরিস্থিতিতে বুধবার পুলিশের তরফে রাস নিয়ে একটি বিশেষ সভা ডাকা হয়। যাতে জেলা পুলিশ সুপার বিশ্বনাথ ঘোষ-সহ পুলিশ কর্তারা হাজির ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন নবদ্বীপের বিধায়ক, পুরপ্রশাসক পর্ষদের চেয়ারপার্সন, বিডিও, হাসপাতালের সুপার, নবদ্বীপ কেন্দ্রীয় রাসোৎসব কমিটির সম্পাদক প্রমুখেরা। কয়েকশো বারোয়ারির প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে নবদ্বীপের আইসি কল্লোলকুমার ঘোষ রাসের ইতিহাস, ঐতিহ্য ব্যাখ্যা করে জানিয়ে দেন, কোভিডের সঙ্গে আট মাস ধরে লড়াই চলছে। এই অবস্থায় নবদ্বীপের রাসের উদ্যোক্তাদের নিজেদের বুঝতে হবে এ বারের রাস কেন অন্য রকম হওয়া উচিত। রাস হবে করোনাকালে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক। অন্যথায় আইন তার নিজের পথে চলবে। এরপর আয়োজকদের তরফে বলতে উঠে অনেকে বাজনার স্বপক্ষে নানা যুক্তি দেখান। হাইকোর্টের নির্দেশের কোথায় কোন ফাঁক রয়েছে, সে সবও সভায় আলোচিত হয়। কিন্তু পুলিশ তাতে বিশেষ প্রভাবিত হয়নি।
নবদ্বীপ পুর-প্রশাসন পর্ষদের চেয়ারপার্সন বিমানকৃষ্ণ সাহা সভায় বলেন, “মনে রাখতে হবে, আদালতে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে জনগণের স্বার্থে। করোনা পরিস্থিতিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে সকলের ভালর জন্য। আমাদের নিজেদের গায়ে যাতে আঁচ না লাগে, সেই রকম ভাবে রাস করব। তবে পুলিশ প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করব, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটু শিথিলতা আনার জন্য।”
এ দিনের সভায় কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, “মনে রাখতে হবে, এখানে প্রশাসন আর রাসের আয়োজকেরা কেউ কারও প্রতিপক্ষ নয়। করোনা পরিস্থিতিতে একটা সমন্বয় ভাবনা নিয়েই আজকের সভা। হাইকোর্টের রায় বা সরকারি নির্দেশের বাইরে আমরা যেতে পারিনা। তা নিয়ে কোনও পছন্দ অপছন্দের সুযোগ নেই। পাঁচটা নির্দেশ আছে, তার মধ্যে আপনি চারটে মানবেন আর একটা মানবেন না, এটা হয় না। আপনাকে পাঁচটাই মানতে হবে।’’
নবদ্বীপের বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা বলেন, “যে জেগে ঘুমায় তার ঘুম ভাঙানো যায় না। আসুন সকলে মিলে অন্তর থেকে রাস উদযাপনের শুভ প্রচেষ্টা গ্রহণ করি। চৈতন্য মহাপ্রভু বিশ্বকে প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। ২০২০ সালে নবদ্বীপ যেন সে পথের অনুসারী হয়।”