ফাইল চিত্র।
রেষারেষির জেরে যখন নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা কৃষ্ণনগরের মানুষের, সেই সময়েই পুলিশ-প্রশাসনের কর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ভাসানের শোভাযাত্রায় এই উচ্ছৃঙ্খলতা এবং হানাহানি মেনে নেওয়া হবে না।
সেটা নব্বইয়ের দশক। ভাসান নিয়ে আলোচনায় বসলেন তৎকালীন জেলাশাসক অতনু পুরকায়স্থ, পুলিশ সুপার মনোজ মালব্য, সিপিএমের মন্ত্রী অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়, জেলা পরিষদের সভাধিপতি সিপিএমের হরিপ্রসাদ তালুকদার ও কৃষ্ণনগরের কংগ্রেস পুরপ্রধান গৌরীশঙ্কর দত্ত।
ঠিক হল, রেয়াত করা হবে না কাউকেই। বরদাস্ত করা হবে না কোন উৎশৃঙ্খলতা। দায়িত্ব দেওয়া হল জেলা পুলিশের তৎকালীন ডিএসপি (সদর) শুভঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে। এই প্রথম কৃষ্ণনগরের মানুষ দেখল পুলিশের দাপট। সামান্য গন্ডগোলেই লাঠি চালাল পুলিশ। এই অভাবিত পুলিশি সক্রিয়তায় কুঁকড়ে গেল মারমুখী বারোয়ারিগুলি।
কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ার বাসিন্দা রীনা মুখোপাধ্যায় বলছেন, “একটা সময়ে মহিলারা ভাসান দেখতে যেতে ভয় পেতেন। শুভঙ্করবাবুর জন্য শহর শৃঙ্খলা ফিরল। মানুষ নির্ভয়ে ভাসান দেখতে বেরল। মেয়েরাও রাত জেগে ভাসান দেখার সাহস পেল।”
শুভঙ্কর চট্টাপাধ্যায়কে তাই এই শহরের আমজনতা মনের মণিকোঠায় রেখে দিয়েছেন পরম যত্নে। বছর কয়েক আগে দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হলে জগদ্ধাত্রীর ঘট বিসর্জনে শোভাযাত্রায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ট্যাবলো বের করেছিল প্রায় প্রতিটি বারোয়ারি।
এত কিছুর পরেও কিন্তু ভাসানে পুরোপুরি শৃঙ্খলা এল না। বড় ধরনের গন্ডগোল বা রেষারেষি না-থাকলেও ভাসান মানেই ভিতরে-ভিতরে একটা উত্তেজনার পরিবেশ। নির্দিষ্ট কোনও বারোয়ারির মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকল না। যখন যারাই মুখোমুখি হয়েছে, তাদের সঙ্গে বেধে গিয়েছে মারামারি। তাতে যুযুধান দুই বারোয়ারির সদস্য ছাড়াও আহত হয়েছে পুলিশ। রক্তাক্ত হয়েছেন ঢাকি এবং বেহারারাও। কখনও নগেন্দ্রনগর যুবগোষ্ঠীর সঙ্গে জজকোর্টপাড়া বারোয়ারি, বাঘাডাঙা বনাম হাতারপাড়া, চকেরপাড়া বনাম ষষ্ঠীতলা বারোয়ারি।
সাম্প্রতিক কালে দুটো বারোয়ারির রেষারেষি নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছিল। রেষারেষির নেপথ্যে ছিল সিপিএমের দুই যুবনেতার নিজেদের মধ্যেকার দড়ি টানাটানি। নগেন্দ্রনগর যুবগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সুমিত চাকি আর চকেরপাড়ার সঙ্গে অরূপ দাস। দু’জনের মধ্যে কে বেশি প্রভাবশালী তা প্রমাণের জন্য ব্যবহার হতে শুরু করে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের ময়দান। যদিও পুলিশের তৎপরতায় তা কোনও দিনই বড়সড় গন্ডগোলের আকার নিতে পারেনি।
এখন পুলিশের মাথাব্যথার কারণ অন্য। নির্দিষ্ট কোনও বারোয়ারি নয়, বরং প্রায় শ’খানেক মদ্যপ ও উচ্ছৃঙ্খল যুবকের দল। তারা কোনও নির্দিষ্ট বারোয়ারির সঙ্গে যুক্ত নয়। ঘুরে-ফিরে নানা বারোয়ারির শোভাযাত্রায় বেরোয়। লোকবল বাড়ানোর জন্য অনেক বারোয়ারিই আপত্তি করে না। কিন্তু এলাকার ছেলে না হওয়ায় বারোয়ারির বড়দের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না এদের উপরে। এরাই নানা সময়ে গন্ডগোল পাকায়। আর তার দায় চাপে সংশ্লিষ্ট বারোয়ারির উপরে।
তবে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের কথা উঠলেই কৃষ্ণনগরের মানুষ যে নামটা আজও করেন, তিনি হলেন দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর দিলীপ শর্মা ওরফে দিলুদা। কালীনগরের রেনবো তাঁর ক্লাব। দ্বিতীয় ভাসানের দিন এই রেনবো ক্লাবের শোভাযাত্রা ছিল প্রধান আকর্ষণ। সাঙে নয়, দিলু শর্মার প্রতিমা যেত গাড়িতে চেপে। পিছনে কয়েকশো মানুষের ভিড়। কারও কারও কাছে অস্ত্র। সকলে সমীহ করে সরে গিয়ে জায়গা করে দিত তাদের। বছর কয়েক আগেও তারই মধ্যে দুধ-সাদা পোশাকে হেঁটে যেতেন সুদর্শন দিলুদা। শহরের শেষ ‘দাদা’।
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী ভাসানে দাদাগিরির দিন বোধহয় ফুরিয়ে এল।
(শেষ)