প্রতীকী ছবি।
মাছের আদলে বানানো বাংলা বর্ণমালার সব অক্ষর। মাছের মুখে লাগানো লোহার জেমস ক্লিপ। ছাত্রের হাতে ধরা ছিপ। ছিপের সুতোয় বাঁধা চুম্বক।
শিক্ষকের কথা মতো ছাত্র ছিপ দিয়ে টপ টপ করে একে একে তুলছে মাছ থুড়ি বাংলা বর্ণমালার নানা বর্ণ। হাসিতে ফেটে পড়ছে গোটা ক্লাস!
ব্ল্যাকবোর্ডে লিখিয়ে নয়, শ্রেণিকক্ষেই ছাত্রের হাতে ছিপ ধরিয়ে এ ভাবেই বর্ণমালার পাঠ দিচ্ছেন চাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মমতা সাহা।
দু’দিনের কর্মশালায় এসে নিজের হাতে বানানো টিএলএমকে এ ভাবে ব্যবহার করলেও তার স্কুলে যে টিএলএমের ব্যবহার সেভাবে নেই তা জানিয়ে মমতা বলছেন, “শিশু শিক্ষায় সাফল্য পেতে শিশুদের এই হাসিমুখই কিন্তু পথ।”
২২ বছর শিক্ষকতা করছেন খরিবোনা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইফুল আবেদিন। এক সময় প্রাথমিক শিক্ষায় টিএলএমের ব্যবহার বাড়াতে রিসোর্স পারসন্স হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তিনিও মানছেন, “শিশুর মননে পাঠদানকে নিয়ে যেতে হলে টিএলএমের ব্যবহারের বিকল্প নেই। অথচ স্কুলগুলিতে এর ব্যবহার কমেছে।”
প্রাথমিক স্তরে টিএলএম ব্যবহার জরুরি তাই নয়, শ্রেণিকক্ষে তার ব্যবহার পাঠদানকে শিশুর কাছে আনন্দদায়ক করে তোলে বলে মনে করেন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্র জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি দেবাশিস বৈশ্যও।
কিন্তু জেলার প্রাথমিক স্কুলগুলিতে পাঠদানে টিচিং লার্নিং মেটিরিয়ালস অর্থাৎ টিএলএমের ব্যবহার যে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে মানছেন তাও।
সেই ব্যবস্থাকে ফের সক্রিয় করতে চাইছে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ।
স্কুলগুলিতে শিক্ষকেরা নিজেরাই সেই সব টিএলএম সামগ্রী বানিয়ে নিতে পারবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে। এ সম্পর্কে শিক্ষকদের সম্যক ধারণা দিতেই রঘুনাথগঞ্জের দুটি চক্রের ২০টি রিসোর্স সেন্টার থেকে প্রায় ৭০ জন শিক্ষককে নিয়ে দু’দিনের কর্মশালা রবিবার শেষ হল রঘুনাথগঞ্জে। “প্রতীচী”র ‘শিক্ষা আলোচনা’ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা যোগ দিলেন তাতে।
তাদের চেষ্টায় ও জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের পৃষ্টপোষকতায় আয়োজিত কর্মশালায় পরিত্যক্ত বিভিন্ন সামগ্রীকে ব্যবহার করে টিএল এম তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়। দেশলাই খাপ, জামার বোতাম, পেনের রিফিল, ফেলে দেওয়া পিচবোর্ডের বাক্স ইত্যাদির সাহায্যে দু’দিন ধরে তৈরি হল একশোটিরও বেশি টিএলএম সামগ্রী। আগে স্কুলগুলিতে টিএলএম তৈরি বাবদ শিক্ষক প্রতি ৫০০ টাকা করে দেওয়া হত। গত দু’বছর থেকে সে টাকার বদলে সর্বশিক্ষা মিশন থেকে তৈরি করা টিএল এম সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছিল। ফলে গুটিকয় ছাড়া প্রাথমিক স্কুলগুলিতে পঠন পাঠনে টিএলএমের ব্যবহার বন্ধই হয়ে যায় প্রায়। এ বছর ফের বরাদ্দ হয়েছে টিএলএমের অর্থ। এই অবস্থায় ফের নতুন করে সমস্ত স্কুলে টিএলএমের মাধ্যমে পঠন পাঠনে জোর দিতে চাইছে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ।
জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি দেবাশিস বৈশ্য বলেন, ‘‘শিশুরা চোখে দেখা, হাতে কলমে করা জিনিস সহজে মনে রাখে। পঠনপাঠনে টিএলএমের ব্যবহার তাই বাড়ানো জরুরি।’’
প্রতীচীর সঙ্গে যুক্ত উত্তর ২৪ পরগনার শাঁড়ফুল হাটখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তিলক মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “বহু স্কুলে টিএলএম সামগ্রী কিনে রেখে আলমারিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কোথাও বা শিক্ষক প্রতি বরাদ্দ ৫০০ টাকা শিক্ষকেরা নিজেরাই খরচ করছেন। শিক্ষকেরা সচেতন না হলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে টিএলএমের ব্যবহার করানো যাবে না। তাই পঞ্চায়েত ভিত্তিতে স্কুলগুলিকে নিয়ে এই ধরনের কর্মশালা জরুরি।”
প্রতীচীর সঙ্গে যুক্ত রঘুনাথগঞ্জের শিক্ষক অম্বুজাপদ রাহার মতে, “সচেতনতার পাশাপাশি টিএলএম নিয়ে স্কুলগুলিতে নজরদারিও প্রয়োজন।”
লবনচোয়ার শিক্ষক সুমন ঘোষ, লালখান্দিয়ার প্রাথমিকের শিক্ষক বিজয় পালিতের কথায়, “মাঠেঘাটে পড়ে থাকা সামগ্রীও নান্দনিক হয়ে উঠেছে এই কর্মশালায়।”