মেয়ের সঙ্গে তোলা প্রিয়াঙ্কার শেষ ছবি।
মেয়ে ভালো নেই জেনেও নিজের অসহায়তার কারনে প্রায় একটা বছর তার ছেড়ে আসা সংসারের অনুষ্কাকে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কার। সৎমার কাছে। সেই আক্ষেপ তার এখনও যাচ্ছে না তার।
মেয়ে যে বেঁচে নেই সেটা বিশ্বাস করতেই সময় গেলেছিল গোটা একটা রাত। হাসপাতালে মেয়ের মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে পাগলের মত একের পর এক ঘনিষ্টকে ফোন করে গিয়েছিলেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। কলকাতার হাসপাতালের নিয়ে যাবেন বলে। আজ সেই মায়ের মন প্রবল ভাবে চাইছে চরম শাস্তি হোক তার মেয়ের খুনিদের।
বাবা দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। শয্যাশায়ী। বেতন পাচ্ছেন না। ভাইটাও তখন চাকরি পায় নি। বাপের বাড়ির সংসারে চরম আভাব। এরই মধ্যে মেয়েতে নিয়ে এসে কষ্ট দিতে চান নি প্রিয়াঙ্কার। ভেবে ছিলেন একটু গুছিয়ে নিয়ে তবেই মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। সোমবার সন্ধ্যে থেকে একটানা কেঁদে চলেছেন তিনি। চোখের কোলে কালী পড়ে গিয়েছে গভীর ভাবে। মেয়ের কথা তুলতেই তিনি বলেন,‘‘সেই সময় সংসারে যা অভাব ছিল তাতে ওকে নিয়ে এসে না খাইয়ে রাখতে হত। তাই ভাবলাম বাবার কাছেই থাক। ওখানে থাকলে তো অন্তত খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবে। ভালো স্কুলে পড়তে পারবে।’’
তাই জীবনের শেষ সম্বল একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে থাকতে বুকটা ফেটে গেলেও তিনি নিজের কাছে মেয়েকে রাখেন নি। তাইতো মাঝে মধ্যেই ছুটে যেতেন মেয়ের কাছে। স্কুল ছুটির পরে দেখা করতেন মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে যে খেতে ভালোবাসে। তাই তাকে নিয়েও যেতেন ভালো কোন হোটেলে। মনের মত করে খাওয়াতেন। তার পর মা-মেয়ে বিদায় নিত চোখের জলে। প্রায়াঙ্কা বলেন,‘‘বিশ্বাস করুণ অনুষ্কাকে ছেড়ে আসতে বুকটা ফেটে যেত। তবুও ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের মনের উপরে পাথর চাপা দিয়ে রাখতাম। সেটাই যে শেষ পর্যন্ত কাল হবে ভাবতে পারিনি।’’
কিন্তু মেয়ে যেদিন তাকে বলল যে সে আর বাবা কাছে ফিরতে রাজি নয়, আমার সঙ্গে নবদ্বীপে চলে আসতে চায় সে দিন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি প্রিয়াঙ্কারদেবী। সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলেন যে মেয়েকে এবার নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। নিজের মত করে গড়ে তুলবেন। সেই মত আইনজীবীর সঙ্গেও কথা বলে ছিলেন। ঠিক হয় ১৯ মে গরমের ছুটি পড়ে গেলে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। তারপর আটকে দেবেন। আর অভিজিৎ এর কাছে মেয়েকে পাঠাবেন না। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।
খেতে ভালোবাসত অনুষ্কা। সক রকম খবারই। সেই হিসাবে হয়ত আইসক্রিমও। কিন্তু সেই ভালো লাগাটা এই পর্যায়ে কখনই ছিল না যে কাউকে সে বিরক্ত করবে। আর এতটাই বিরক্ত করবে যে তাকে মেরে ফেলতে হবে। প্রিয়াঙ্কার বলেন,‘‘আমার মেয়েকে আমি যতটা চিনি তাতে সে অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। খুব প্রিয়জন না হলে সে কিছু চাইবে না। মৌটুসির সঙ্গে তার তেমন সম্পর্কই তৈরি হয় নি যে অইসক্রিমের জন্য বায়না করবে। অনুষ্কাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে।’’
আর মৌটুসি যতই দাবি করুক না কেন এই খুনের সঙ্গে অভিজিৎ এর কোন সম্পর্ক নেই সেটা বিশ্বাসই করেন না প্রিয়াঙ্কা। তিনি বলেন,‘‘মৌটুসির গল্প আমি বিশ্বাস করি না। সব বানানো। অভিজিৎ এর পূর্ণ সমর্থণ আর প্রশ্রয় ছাড়া সে এটা করতে পারে না। আমি ওদের দু’জনেরই চরম শান্তি চাইছি।’’
বিয়ে হয়েছিল ২০০৮ সালে। আর ডিভোর্স হয়েছে ২০১৫ সালের জুন মাসে। কিন্তু ডিভোর্সের অনেক আগে থেকেই মা-মেয়েকে কৃষ্ণনগরের জোড়াকুঠির বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নগেন্দ্রনগরে বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে থাকতেন অভিজিৎ। অনুষ্কা থাকত প্রিয়াঙ্কার কাছে। তবে তার বাবা কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি থাকতেন বলে সেখানে প্রায় দিনই পড়ে থাকতে হত তাকে। তখন অনুষ্কা থাকত ঠাকুমার কাছে। বাবার সঙ্গে। ফলে মাকে একেবারে ছেড়ে থাকতে হবে বলে তেমন আলাদা কোন অনুভূতি তৈরি হয় নি অনুষ্কার। কারণ সে এটাতে কিছুটা হলেও অভ্যস্ত ছিল।
আর সেই সঙ্গে বুদ্ধিমান অনুষ্কাও একটু একটু করে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এমনকি তার বাবা যে একটা নতুন বিয়ে করেছে সেটাও প্রিয়াঙ্কাকে জানায় নি অনুষ্কা। কেন? প্রিয়াঙ্কার দেবী বলেন,‘‘প্রশ্নটা আমিই ওকে করেছিলাম। কী উত্তর দিয়েছিল জানেন? বলেছিল ‘তুমি কষ্ট পাবে তাই মা।’ ভাবুন একবার। সেই মেয়ে নাকি আইসক্রিমের জন্য এতটাই বায়না করবে যে মেরে ফেলতে হবে। বিশ্বাস হয়। কেউ বিশ্বাস করবে?’’
না। অনেকেই বিশ্বাস করেনি। জেলার দুঁদে পুলিশ অফিসাররাও না। তাইতো অপরাধ স্বীকার করে নেওয়ার পরও প্রকৃত কারণ জানতে জেরা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। যদিও এখনও নিজের অবস্থানেই অনড় আছে মৌটুসি। সে থাকুক। কিন্তু অভিজিৎ যে নির্দোষ সেটা প্রিয়াঙ্কার মত মানতে চাইছেন না অনেকেই। জেলার এক পুলিশকর্তার কথায়,‘‘মৌটুসি বলতেই পারে। কিন্তু আমাদের সে কথা মানতে হবে এমনটাতো নয়। এই ঘটনায় অভিজিৎ এর ভূমিকা আরও ভালো করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
একে একে গ্রেফতার হয়েছে অভিযুক্তরা। নিজের অপরাধ স্বীকারও করে নিয়েছে মৌটুসি। কিন্তু এত কিছুর পরও আক্ষেপ যাচ্ছে না প্রিয়াঙ্কার। মেয়ের কথা বলতে বলতে মাঝে মধেই উদাসীন হয়ে পড়ছেন। কিছুটা যেন নিজের মনেই বলছেন,‘‘ মাত্র তো দশটা দিন। তারপরই তো মেয়েকে নিয়ে আসতাম নিজের কাছে। এই কটা দিনও ওরা মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখল না। একেবারে মেরে ফেলতে হল?’’