আর ওঝা নয়, দাহ সেরেই প্রচারে

বাবাকে হারিয়ে অশৌচ পোশাকেই তাই সোমবার বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, জনে জনে বলছেন, ‘‘দেখলেন তো বাবার কি হল! গ্রামের থাকেন সাপ-খোপ কামড়ালে আর দয়া করে ওঝা নয়, হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।’’

Advertisement

বিমান হাজরা

সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৮ ০৭:৩০
Share:

প্রচারে সৌরভ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

ঝাড়ফুঁক, নিম ডালের শাসনের পরে সাপে কাটা মানুষটা যখন নেতিয়ে পড়েছেন, রাত তখন ভোরের দিকে।

Advertisement

ওঝারা নিশ্চুপে ফিরে যেতে পরিজনেরা তাঁকে নিয়ে ছুটেছিলেন প্রায় ২৫ কিলোমিটার দুরের মহকুমা হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের গেটে গাড়ি ঢোকার মুখেই মারা গিয়েছিলেন সদ্য পঞ্চাশ জিতেন্দ্রনাথ দাস। রবিবার বাবার দাহ করে বাড়ি ফিরে নিজেকে শান্ত করতে পারছেন না জিতেনবাবুর এমএ পড়ুয়া ছেলে সৌরভ। সে রাতে ছিলেন সুতিতে, মাসির বাড়িতে। সোমবার সকালে গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সৌরভ বলছিলেন, “বাড়িতে মা ছিলেন একাই। সাপে কেটেছে শুনে প্রতিবেশিরাই গ্রামের তিন ওঝাকে ডেকেছিলেন। আমি থাকলে তা হতেই দিতাম না। ওই সময়টা নষ্ট না করলে বাবা চলে যাওয়ার কথাই নয়।’’

বাবাকে হারিয়ে অশৌচ পোশাকেই তাই সোমবার বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, জনে জনে বলছেন, ‘‘দেখলেন তো বাবার কি হল! গ্রামের থাকেন সাপ-খোপ কামড়ালে আর দয়া করে ওঝা নয়, হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।’’

Advertisement

ঠিক প্রচার বলতে চান না, তবে মরিয়া সৌরভ রবিবার থেকে সৌরভ এ কাজটাই করে চলেছেন। প্রলাপের মতো বলছেন একটাই কথা, ‘‘হাত জোড় করে বলছি, এ বার অন্তত বুঝুন, সাপে কাটলে হাসপাতালই একমাত্র ঠিকানা।’’

দামোশ বিল লাগোয়া জল জঙ্গলে ভরা বালিয়ার রামনগর গ্রামে বরাবরই সাপের উৎপাত বেশি। মাসে দু-চার জনকে সাপে কাটেনি, এমনটা হয়নি কখনও। আশপাশে না আছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, না আছে ডাক্তার অ্যাম্বুল্যান্স। এলাকায় ওঝাদের বাড়বাড়ন্ত তাই। ওই গ্রামেই রয়েছেন অন্তত ১১ জন ওঝা। চাষবাসের পরে বাকি সময় ওঝা-গিরি।

গ্রামের মহিলা সুনীতি প্রামাণিককে, এক বছরে দু-দুবার কামড়েছে সাপে। সাপের কামড় খেয়েছেন কমলা প্রামাণিকের ভাইপো চিরঞ্জিতও। বিধবা পাতাশি দাস বাড়িতে একাই থাকেন। দু’বছরের মধ্যে বার পাঁচেক সাপে কেটেছে তাঁকে। তবে পাতাশিদের ওঝা নির্ভরতা কমেনি। উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ুয়া কার্তিক দাস বলছেন, “এক সপ্তাহ আগেই দামোশের বিলে নেমে মাছ ভেবে হাত বাড়িয়েছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত কামড়ে ধরল ঢোঁড়া সাপে। বাড়ি গিয়ে ক্ষতস্থানে চুন লাগিয়েছিলাম। তাতেই সেরে গেছে।”

সাপের কামড়ে মৃত জিতেন্দ্রনাথের দাদা বছর ৬৫ বয়সের নির্মলও বলছেন, “এক মাসও পেরোয়নি বাড়িতে আমাকেও কামড়েছিল সাপে, ডান পায়ে। তবে কি জানেন, গতিক নেই দেখে ওঝাকেই ডেকে ঝাড়ফুঁক করিয়েছিলাম।’’

গ্রাম পঞ্চায়েত কর্মী সুরজিৎ দাস বলছেন, “আসলে গ্রাম থেকে হাসপাতাল বহু দূরে। আশপাশের তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত বালিয়া, কাবিলপুর, মনিগ্রামে কোনো সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স নেই। ভাড়ার গাড়িও সব সময় মেলে না। তাই নিরুপায় মানুষ ওঝাদের উপরেই ভরসা খোঁজেন।’’

আর সৌরভ বলছেন, “এ বার ভ্রান্তিটা কাটুক। এটাই যেন সর্প দংশনের শেষ মৃত্যু হয়। আমি এ বার গ্রামে গ্রামে বোঝাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন