প্রশ্নের মুখে তেষ্টার জল

আয়রনে রক্ষা নেই, দোসর আর্সেনিক। অগত্যা গ্যাঁটের টাকা খচ করে পানীয় হিসেবে জল কিনে খাচ্ছেন জেলার লোকজন। কিন্তু সেই জল কোথা থেকে আসছে, কতটা নিরাপদ তার ব্যাখ্যা মেলা না।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও ইন্দ্রাশিস বাগচী

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৯ ০১:০৪
Share:

নজরে জল-কল: হরিহরপাড়ায়। ছবি: মফিদুল ইসলাম

দুধ, ঘি, সর্ষের তেল, মশলা, কীটনাশক, রাসায়নিক সার— একটার পর একটা ভেজাল-কাণ্ড দেখেছে মুর্শিদাবাদ। তার পরেও বেশ নিশ্চিন্তেই আঁজলা ভরে জল খেতেন লোকজন। এ বার সেই তেষ্টার জল নিয়েও প্রশ্ন উঠল।

Advertisement

আয়রনে রক্ষা নেই, দোসর আর্সেনিক। অগত্যা গ্যাঁটের টাকা খচ করে পানীয় হিসেবে জল কিনে খাচ্ছেন জেলার লোকজন। কিন্তু সেই জল কোথা থেকে আসছে, কতটা নিরাপদ তার ব্যাখ্যা মেলা না। তার পরেও নিরুপায় হয়ে বাজার থেকে ‘পরিস্রুত’ পানীয় জল কিনে খাচ্ছেন অনেকেই। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে এই কেনা জল কতটা পরিস্রুত ও নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসনও।

গত সপ্তাহে বহরমপুর থানার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে বেআইনি জল কারবারির বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিল রাজ্য জল অনুসন্ধান ও উন্নয়ন দফতরের জেলা শাখা। সে দিন বহরমপুর শহর লাগোয়া এলাকায় তিনটি বেআইনি পানীয় জল প্রকল্পে হানা দিয়ে জিনিসপত্র আটক করা হয়। গ্রেফতার করা হয় দু’জনকে।

Advertisement

মঙ্গলবার জেলা খাদ্য সুরক্ষা দফতর, লিগ্যাল মেট্রোলজি, জেলা দুর্নীতি দমন শাখা ও বহরমপুর থানার পুলিশ বেআইনি জল প্রকল্পের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। এ দিন বহরমপুর, কান্দি, শমসেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুরের বেশ কিছু এলাকায় অভিযান চলেছে। বহরমপুরের বুধুরপাড়া, গোয়ালজান ঠাকুরপাড়া ও নিয়াল্লিসপাড়া হল্টে তিনটি জল প্রকল্পে হানা দেয় তারা। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারায় সেগুলিকে বন্ধ রাখার নোটিসও দেওয়া হয়।

বহরমপুরের বানজেটিয়ায় একটি জলপ্রকল্প প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মধ্যে শুধুমাত্র কীটনাশক নিয়ন্ত্রণের শংসাপত্র পায়নি। এ দিন সেখান থেকেও জলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। অন্য দিকে, প্রশাসন এই জল অভিযান শুরু করায় বেআইনি জল কারবারিদের কেউ কেউ প্রকল্প বন্ধ রেখেছেন। মঙ্গলবার সকাল থেকে হরিহরপাড়ার একাধিক জল প্রকল্প বন্ধ ছিল বলে জানা গিয়েছে।

খাদ্য সুরক্ষা দফতরের জেলার দায়িপ্রাপ্ত আধিকারিক তথা উপ মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক ২ পার্থপ্রতিম গুপ্ত বলছেন, ‘‘বেআইনি দুধের কারবারিদের পাশাপাশি বিভিন্ন হোটেল, রেস্তরাঁয় আমরা বরাবরই অভিযান চালাই। এ বারে বেআইনি পানীয় জলের সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হল।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা এ সবের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চালাচ্ছি। যারা খাদ্য সুরক্ষার লাইসেন্স ছাড়াই প্যাকেটজাত জল তৈরি করছে সেই জলের গুণগত মান কী, কতটা পরিস্রুত তা আমরা জানি না।’’

খাদ্য সুরক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, অনুমোদন ছাড়া জল প্রকল্পের জল কী করে নিরাপদ হয় সে-ও এক রহস্য। মুর্শিদাবাদ আর্সেনিক কবলিত এলাকা। ফলে পরিস্রুত জল বলে লোকে যা কিনে খাচ্ছেন তা আদৌ পরিস্রুত কি না তা নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই। এ ছাড়া এই ধরনের প্রকল্পে কোনও পরীক্ষাগার নেই। সেই জলে কী মেশানো হচ্ছে তা নিয়েও অন্ধকারে খাদ্য সুরক্ষা দফতর।

২০১৭ সাল থেকে অনলাইনে খাদ্য সুরক্ষার লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। জেলায় এখনও পর্যন্ত পাঁচটি পানীয় জল প্রস্তুতকারক সংস্থা খাদ্য সুরক্ষা দফতর থেকে লাইসেন্স নিয়েছে। ফলে যারা খাদ্য সুরক্ষা দফতরের লাইসেন্স নেয়নি সেগুলি যে অবৈধ তা বলাই বাহুল্য। আর সেই সব জল প্রকল্পের বিরুদ্ধেই এ দিন অভিযানে নেমেছিল খাদ্য সুরক্ষা দফতর।

রাজ্য জল অনুসন্ধান দফতরের হিসেব অনুযায়ী মুর্শিদাবাদের ২৩টি সংস্থাকে মাটির তলা থেকে জল তোলার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, জেলা জুড়ে পাড়ায় পাড়ায় অনুমোদন ছাড়াই ছোট ছোট প্রকল্প গড়ে উঠেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘরের বারান্দায়, সিঁড়ির তলায়, ঘুপচি ঘরে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এমন বহু প্রকল্প চলছে। কোথাও এক লিটার, দু’লিটার, পাঁচ লিটার, ২০ লিটারের জারে জল ভর্তি করা হচ্ছে।

সেই জল লোকজন প্রকল্প থেকে যেমন নিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি গাড়ি করে বাড়ি বাড়িও পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। জেলায় প্রায় দু’হাজার এ রকম পানীয় জল প্রকল্প রয়েছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পরে গত এক মাসে ২০০টি সংস্থাকে শো-কজ

করা হয়েছে।

হরিহরপাড়া এক প্যাকেটজাত জল প্রস্তুতকারণ সংস্থার মালিক বলছেন, ‘‘লাইসেন্স পেতে একাধিক দফতরে আবেদন করতে হয়। এক দফতরের ছাড়পত্র মিললেও অন্য দফতরে আটকে যায়। ফলে পঞ্চায়েত থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছি। আমরা চাই সরকার লাইসেন্সের দেওয়ার বিষয়টি সরলীকরণ করুক।’’

কিন্তু জল নিয়ে এমন ছেলেখেলা কেন? কী ভাবেই বা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠল এমন বেআইনি জল প্রকল্প? প্রশাসনই বা এত দিন হাত গুটিয়ে বসেছিল কেন? প্রশ্ন রয়েছে। সদুত্তর নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন